রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাতদফা প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তার প্রস্তাবগুলো হলো -- প্রথমত, রাখাইনের যুক্তিসঙ্গত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তব রোডম্যাপ তৈরি করা; দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমার এবং আরাকান সেনাবাহিনীর উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করা, যা সম্প্রতি বাংলাদেশে আসা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের মাধ্যমে শুরু করা হবে; তৃতীয়ত, রাখাইনকে স্থিতিশীল করার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ করা এবং স্থিতিশীলতা পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি স্থাপন করা; চতুর্থত, রাখাইন সমাজ এবং শাসনব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের টেকসই একীকরণের জন্য আস্থা তৈরির ব্যবস্থা সমর্থন করা; পঞ্চমত, যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার সম্পূর্ণ অর্থায়নের জন্য দাতাদের অবদান একত্রিত করা; ষষ্ঠত, জবাবদিহিতা এবং পুনরুদ্ধারমূলক ন্যায়বিচার অনুসরণ করা এবং সপ্তমত, মাদক-অর্থনীতি ভেঙে ফেলা এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘে উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনে তিনি এই সুপারিশ তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিশ্ব রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারবে না। আজ, আসুন আমরা এই সংকট চিরতরে সমাধানের জন্য একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করি। বাংলাদেশ এই লক্ষ্যে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করতে প্রস্তুত।

তার আগে তিনি উল্লেখ করেন, গণহত্যা শুরু হওয়ার আট বছর পরও রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অব্যাহত রয়েছে। সংকট নিরসনের উদ্যোগের অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক তহবিলের উদ্বেগজনক ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমার থেকেই। এর সমাধান সেখানেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মিয়ানমার এবং আরাকান সেনাবাহিনীর উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে যাতে তারা অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বন্ধ করে রাখাইনে তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ শুরু করে। এটিই সংকটের একমাত্র সমাধান। মিয়ানমারে বৃহত্তর সংস্কারের কাছে এটিকে জিম্মি করে রাখা উচিত নয়। বাংলাদেশ এই সংকটের শিকার।

তহবিল হ্রাস পাওয়ায়, একমাত্র শান্তিপূর্ণ বিকল্প হল তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা। এর জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষা অব্যাহত রাখার চেয়ে অনেক কম সম্পদের প্রয়োজন হবে। রোহিঙ্গারা ধারাবাহিকভাবে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে, যারা সম্প্রতি সংঘাত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের প্রত্যাবাসনের অনুমতি দিতে হবে। বাংলাদেশ এই সংকটের শিকার। আমাদের বিশাল আর্থিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত মূল্য বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। রাখাইন দিয়ে বাংলাদেশে মাদকের প্রবাহসহ অপরাধমূলক কার্যকলাপ আমাদের সামাজিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যসহ আমাদের উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে, আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের অনুমতি দিতে পারছি না।

এদিন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশে চলমান গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কার উদ্যোগে তার পূর্ণ সমর্থন ও সংহতির অঙ্গীকার করেছেন। সোমবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ অঙ্গীকার করেন। বৈঠকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া এবং এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।

বৈঠকে রাজনৈতিক সংস্কার, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত নৃশংসতার দায় নিরূপণ, সংরক্ষণবাদী শুল্ক নীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য উদ্বেগ এবং আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার পদক্ষেপ এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতের অঙ্গীকার মহাসচিবকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন আয়োজনে আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।

তিনি অভিযোগ করেন, ক্ষমতাচ্যুত শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসররা চুরি করা অর্থ ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ‘তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন চায় না। কিছু আন্তর্জাতিক মহলও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে,’ বলেন অধ্যাপক ইউনূস। এর জবাবে মহাসচিব গুতেরেস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জাতিসংঘের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘের ধারাবাহিক ভূমিকার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি গত ১৪ মাস ধরে প্রধান উপদেষ্টার প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের এ কঠিন উত্তরণ প্রক্রিয়ায় তার নেতৃত্বকে তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখছেন।

এদিকে রোহিঙ্গা জনগণকে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন করাই এ দীর্ঘস্থায়ী সংকটের একমাত্র কার্যকর সমাধান বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানো একমাত্র কার্যকর সমাধান। এক্ষেত্রে কোনো বিকল্প নেই। সোমবার নিউইয়র্কে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপের সঙ্গে সাক্ষাতে অধ্যাপক ইউনূস এমন মন্তব্য করেন। বৈঠকে তারা রোহিঙ্গা সংকট, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল ঘাটতি এবং মঙ্গলবারের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আলোচনা হতে যাওয়া সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। জুলি বিশপ রোহিঙ্গাদের সহায়তায় তহবিল উৎস বৈচিত্র্য করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং ওআইসি সদস্য দেশগুলোকে তাদের অবদান বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান।

হিন্দু নির্যাতনের দাবি নাকচ :

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে সংবাদমাধ্যম জেটিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভুয়া খবর ছড়ানো। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কোন সহিংসতা হচ্ছে না। সহিংসতার অভিযোগ ভিত্তিহীন।’ সাংবাদিক মেহেদি হাসান এই সাক্ষাৎকার নেন। তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গও মনে করিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছর তাকে দেশের দায়িত্ব নিতে আহ্বান জানায় তারা। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, প্রথমে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন এবং দায়িত্ব নিতে চাননি। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ত্যাগ দেখে মত বদলান। তার ভাষায়, ‘আপনারা এত কিছু ত্যাগ করেছেন, তাই আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছি।’

সাক্ষাৎকারে মেহেদি হাসান একাধিক প্রশ্ন তোলেন, জাতীয় নির্বাচন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির আগে কেন হচ্ছে না? মিয়ানমারের ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী? শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে কার্যত নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত তিনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? সাক্ষাৎকারটি সোমবার জেটিও প্রকাশ করেছে।