প্রধান উপদেষ্টা ও বিজিএমইএর শোক

রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন। নিহতদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি কোন সূত্র। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্যমতে, রাসায়নিকের গুদামের আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছে। তিন তলা পোশাক কারখানার আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার পর সেখানে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়েই আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ শুরু করে। রাসায়নিকের গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরী হওয়ার কারণ হিসেবে সেখানে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক, হাইড্রোজেন পারঅক্সাাইড ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, এই দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। আমরা এই শোকের সময়ে তাদের পরিবারের পাশে আছি। প্রধান উপদেষ্টা অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন।

এদিকে, ঘটনাস্থল হতে আলামত সংগ্রহ করার জন্য কাজ করছে সিআইডি’র ক্রাইম সিন ও কেমিক্যাল ল্যাব এক্সপার্টগণ।

মিরপুরে শাহ আলী ওয়াশিং লিঃ ও রাসায়নিক গোডাউনে আগুন লেগে হতাহতের ঘটনায় বিজিএমইএ গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। পাশাপাশি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে বিজিএমইএ। বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানায়, মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএ এর সদস্যভূক্ত কোন পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা।

ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, শিয়ালবাড়িতে চারতলা ভবনে থাকা আনোয়ার ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানা এবং তার পাশে থাকা টিনশেড ঘরে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে। অজ্ঞাত উৎস থেকে লাগা আগুনের খবর পেয়েই তারা সেখানে ছুঁটে যায়। গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সুত্রগুলো জানায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন।

এর মধ্যে কারখানা থেকে ৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। পরে সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ জন হওয়ার কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস।

বিকেলে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, তল্লাশি অভিযান এখনো চলমান। পাশের যে কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে, সেখানে এখনো আগুন জ্বলছে। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওখানে কাউকে যেতে দিচ্ছি না। আমরা সর্বোচ্চ প্রযুক্তি দিয়ে, ড্রোন দিয়ে এসব কার্যক্রম করছি।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, আগুনের সূত্রপাত কিভাবে তা এখনো জানা যায়নি। যাঁরা শুরুতে আগুন নেভাতে এসেছেন, তাঁরা রাসায়নিকের গুদাম ও গার্মেন্টস দুই দিকেই আগুন দেখেছেন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, পোশাক কারখানার নিচতলায় ওয়াশ ইউনিট রয়েছে। সেখানে প্রথম আগুন লাগে। সেই আগুন পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আগুন চারতলা পোশাক কারখানার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

শিয়ালবাড়ির যে সড়কে পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছে, এর পাশের সড়কেই একটি শোরুমে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন আফজাল সরকার। অগ্নিকাণ্ডের শুরু তিনি দেখেছেন বলে জানান। আফজাল বলেন, আগুন প্রথমে লাগে কারখানার নিচতলায় ওয়াশ সেকশনে। এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পরে সেখান থেকে পাশের টিনের ছাউনির রাসায়ানিক গুদামে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তখন গুদামে একটি বিস্ফোরণ হয়। এতে গুদামের রাসায়নিকের ড্রামগুলো ছিটকে পড়ে। তখনই আগুন আরও বেড়ে যায় এবং পুরো কারখানায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কারখানার কিছু কর্মী বের হতে পারলেও বেশির ভাগই ভেতরে আটকা পড়েন বলে জানিয়েছেন তিনি।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, রাসায়নিকের গুদামে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

ঘটনার পর থেকে রাসায়নিকের গুদামের মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানান ফায়ার ব্রিগেডের পরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, দেখে মনে হচ্ছে, এই রাসায়নিকের গুদামের অনুমোদন নেই। যাচাই-বাছাই করে তদন্ত করে বিস্তারিত পরে জানা যাবে।

ছবি হাতে নার্গিসের মায়ের আর্তনাদ : মেয়ে নার্গিস আক্তারের কোনো খবর পাচ্ছেন না মা সুরমা বেগম। মেয়ের পাসপোর্ট সাইজের ছবি হাতে আহাজারি করছেন তিনি। বারবার বলছেন, আর্মি, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস কেউ কিছু বলতাছে না। ভেতরে কী অবস্থা, মাইয়াডার কিছু হইল কি না, কিছুই জানি না। আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন সুরমা বেগম।

মিরপুর-১ গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা সুরমা বেগম জানান, দুই সপ্তাহ হয় তাঁর মেয়ে নার্গিস আনোয়ার ফ্যাশন নামের ওই তৈরি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে চাকরি নিয়েছিল। মেয়েকে তিনি বাসাতেই সেলাইয়ের কাজ শিখিয়েছিলেন। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে বাসায় বসে না থেকে মেয়ে নিজেই খোঁজ করে এখানে চাকরি নেয়।

উদ্ধার হওয়া লাশ পুড়ে অঙ্গার, পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে : পোশাক কারখানা থেকে প্রথমে যে নয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে যে দেখে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হবে বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, যে ৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সবগুলোই পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। লাশ দেখে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।

স্বজনের খোঁজে মিরপুরে ছবি হাতে অনেকে : রূপনগরে পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামের আশপাশে স্বজনের খোঁজে ঘুরছেন অনেক মানুষ। তারা বলছেন, আগুন লাগার পর থেকে স্বজনদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তারা। মোবাইল ফোনেও সাড়া পাচ্ছেন না তারা। ইতোমধ্যে ওই আগুনে ১৬ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস; যাদের সবার লাশ পোশাক কারখানাটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

নিহতদের নাম পরিচয় এখনও জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। তাদের চেনার উপায় নেই বলে জানানো হয়েছে। এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। দুপুরে লাগা আগুন বিকালেও নিয়ন্ত্রণে না এলে এবং মৃত্যুর খবর আসতে থাকলে সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে স্বজনদের।

ভাইয়ের ছেলে রবিনের ছবি হাতে ঘটনাস্থলের এদিক সেদিক যাচ্ছেন নাসিমা আক্তার। তিনি বলেন, এখানে জিএম ফ্যাশন নামে একটি কারখানায় কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করছিলেন রবিন। তার কর্মক্ষেত্র ছিল পুড়ে যাওয়া ভবনটির তিন তলায়।

নাসিমা বলেন, ভবনের পাঁচতলা থেকে শ্রমিকরা বের হতে পারলেও তিনতলা থেকে কেউ বের হতে পারেনি। এখন পুরো পরিবারের সদস্যরা রবিনের ছবি হাতে খুঁজতে বেরিয়েছেন।

পোশাক কারখানায় কাজ করা খালিদ হাসান সাব্বিরকে খুঁজছেন তার মামাতো ভাই শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, সাব্বির আরমান গার্মেন্টসের স্টোর ইনচার্জ ছিলেন। সাব্বিরের ফোন এখনও বাজছে। তবে কেউ ধরছেন না।

ঘটনাস্থলে বন্ধু সারোয়ারের ছবি হাতে ঘুরছেন আমানুল্লাহ। তিনি বলেন, তার বন্ধু সেখানকার একটি ‘ওয়াশিং ফ্যাক্টরিতে’ হেলপারের কাজ করতেন। অল্প কয়েকদিন হল সারোয়ার এখানে কাজে যুক্ত হয়েছেন। আগুন লাগার পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বেলা পৌনে ১২টার দিকে রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকার কসমিক ফার্মা নামের একটি রাসায়নিকের গুদাম এবং পাশের পোশাক কারখানায় আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট সেখানে নিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। তারা পোশাক কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও রাসায়নিকের গুদামে সন্ধ্যার পরও আগুন জ্বলছিল।

টিন শেড রাসায়নিকের গুদামটির মালিক ‘আলম সাহেব’ বলে স্থানীয়রা জানান। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সেখান থেকে শুরু হওয়া আগুনটি পরে সামনের একটি পোশাক কারখানাতেও ছড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টার পরও ঘটনাস্থলে রাসায়নিকের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্ধারকর্মীদের সহায়তায় পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে তৎপর রয়েছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরাও। এরমধ্যে সেখানে নিখোঁজদের সন্ধান পেতে ভিড় করছেন স্বজনরা।