এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কিবরিয়া গোলাম মোহাম্মাদ ওরফে জি এম কিবরিয়া, যিনি ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তিনি সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইতালি আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসাথে ফ্যাসিস্টের আরেক দোসর কিবরিয়ার স্ত্রী সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক হোসনে আরা বেগমকে কাগজে কলমে কোম্পানির ওভারসিজ এজেন্সি ডিরেক্টর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ফ্যাসিস্টের সহযোগী জিএম কিবরিয়া ও তার স্ত্রী হোসনে আরাকে ২০২১ সালে উপটৌকন হিসেবে এই লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির লাইসেন্স দেয় পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তদন্তে উঠে এসেছে কোম্পানিটির নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের চিত্র।
সূত্রমতে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের কিছু শীর্ষ কর্তা বিতাড়িত হলেও তাদের অধিকাংশ প্রেতাত্মারাই বহাল তবিয়তে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী নানা পদে। দেশের অন্যতম বীমা প্রতিষ্ঠান এনআরবি ইসলামিক লাইফ এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদের প্রায় সব ক’টিতেই ফ্যাসিবাদের সাথে সরাসরি জড়িতরাই দাপটের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। নামে -বেনামে কমিশনের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিবাদি আচরণে এখনো অতিষ্ঠ সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ফ্যাসিবাদের সাথে জড়িতরা এখনো এনআরবি ইসলামিক লাইফে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানের ৯ মাস পরও ফ্যাসিবাদিদের প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদে বহাল থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভ ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জানা গেছে, এনআরবি ইসলামিক লাইফে ফ্যাসিবাদের দোসররা নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের নানা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। সূত্রমতে, অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্পনা বিক্রি, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চহার, ক্যাশ ইন হ্যান্ডের নামে অর্থ আত্মসাত, একক প্রিমিয়ামকে মেয়াদি বীমা দেখিয়ে ব্যাপক তহবিল লোপাট, সম্পদ বিনিয়োগে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষিত-অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবছর যে পরিমাণ প্রিমিয়াম আয় হয়েছে তার অধিকাংশ এসেছে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প “সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা” থেকে। যার মেয়াদকাল ৬, ৮, ১০, ১২, ও ১৫ বছর হলেও প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ৬ বছর মেয়াদে একক প্রিমিয়াম গ্রহণ করে চলেছে।
সূত্র মতে, কোম্পানি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০২১ সালে এই পরিকল্প থেকে একক প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ৩০ লাখ টাকা। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে এই পরিকল্প থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয় প্রায় ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। গত তিন বছরে এই পরিকল্প থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয় প্রায় ২৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এই বিশাল পরিমাণ প্রিমিয়ামের উপর জীবন বীমা ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালা-২০২০ অনুযায়ী এক কিস্তি বীমায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশ হারে ব্যয় করার কথা ছিলো ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু আইডিআরএ’র নির্দেশনা অমান্য করে কৌশলে ডাটা জালিয়াতির (একক বীমা প্রিমিয়ামকে মেয়াদি বীমায় রূপান্তর) মাধ্যমে কখনো ৪৫ শতাংশ আবার কখনো তার চেয়েও বেশি হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে গ্রাহকের অর্থ পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম, নবায়ন ও গ্রুপ বীমা থেকে মোট সংগ্রহ করে ৮১ কোটি টাকা। এরমধ্যে ২০২১ সালে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করে ৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ২০২২ সালে ১ম বর্ষের প্রিমিয়াম ২৭ কোটি টাকাসহ নবায়ন ও গ্রুপ বীমা মিলে আয় করে ২৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে একইভাবে ১ম বর্ষের প্রিমিয়াম ৩৬ কোটি টাকাসহ নবায়ন ও গ্রুপ বীমা মিলে ৪৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা সংগ্রহ করে।
উল্লেখ্য, গত তিন বছরে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম, নবায়ন ও গ্রুপ বীমা আয় ৮১ কোটি টাকার মধ্যে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প “সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা” থেকে এককালীন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। এনআরবি ইসলামিক লাইফ এ যাবত ৮১ কোটি টাকা ব্যবসা করলেও প্রতিষ্ঠানটি লাইফ ফান্ড সন্তোষজনক অবস্থায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো কোম্পানি একক কিস্তি বীমা পরিকল্প থেকে এককালীন হারে যে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে তার সবটুকুই ডাটা জালিয়াতি করে ঘাটতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে বর্তমানে কোম্পানি চরম তারল্য সংকটে রয়েছে। কোম্পানির বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান মাহফেল হক এন্ড কোম্পানি ২০২২ সালে তাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের এম্ফেসিস অব ম্যাটার হেডে ২০২১ ও ২০২২ সালে মোট ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা ক্যাশ ইন হ্যান্ডে বাস্তবে পাননি বলে উল্লেখ করেন। প্রতিষ্ঠানটির এই আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে কোম্পানির ক্যামেলকো বিএফআইইউতে এসটিআর-এসএআর না করায় বিস্মিত হয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্তদের বক্তব্য নেয়ার একাধিকবার চেষ্টা করেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।