আর্থিক খাতে দুর্নীতি, লুটপাট ও অপশাসনের কারণে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার এই খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল সোমবার বিকেল ৩টায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনকালে এ মন্তব্য করেন তিনি।
বাজেট উপস্থাপনকালে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এই খাতকে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছে। ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে এবং সেগুলো বারবার পুনঃতফসিল করে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করা হয়েছে।
তিনি জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং চালু করায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জুনে যেখানে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসে খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন সরকার আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এই সংস্কারের অংশ হিসেবে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ খসড়া করা হয়েছে, যা মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট ও সম্ভাব্য দেউলিয়াত্ব মোকাবিলায় সহায়ক হবে। এছাড়া তিনটি পৃথক টাস্কফোর্স গঠনের কথা জানান অর্থ উপদেষ্টা, যার কাজ হবে ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত পর্যালোচনা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে নীতি ও প্রবিধান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং দেশি-বিদেশি চুরি বা পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাজেট দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানান সালেহউদ্দিন আহমেদ।
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, গত দেড় দশকে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাই আমরা নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেছি এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন, নীতিমালা ও আদেশ সংশোধন ও সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বিনিয়োগকারীদের একটি ‘পাইপলাইন’ গঠন করছে, যাতে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তব বিনিয়োগে রূপান্তর করা যায়। এর মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে।
বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার সম্ভাবনাময় খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জন্য আগামী অর্থবছরের জন্য পিপিপি তহবিলে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের
প্রস্তাব করছি। বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)’র ওপর অর্পণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া কোরিয়ান ইপিজেডের দীর্ঘদিনের জমি-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হয়েছে বলেও জানান সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, আগামী ১০ বছরে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অঞ্চলগুলো হলো: জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিলেটের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল-৩ (ধলঘাটা), বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চল, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, চাঁদপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল-১, কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কুড়িগ্রাম অর্থনৈতিক অঞ্চল।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি অপরিহার্য। আমরা দেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে দ্রুত তা দূর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্যেই গত এপ্রিল মাসে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’ আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রায় ৪৫০ জন বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করেন। তিনি জানান, ওই সম্মেলনে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৫ কোটি ডলারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান ‘শপ-আপ’ একাই ১১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ অর্জন করে।
সালেহউদ্দিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ ৫৩টি দেশের অংশগ্রহণে মহাকাশ অনুসন্ধান কর্মসূচি ‘নাসা-আর্তেমিস’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের তরুণরা মহাকাশ গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। বিনিয়োগকারীদের দ্রুত ও সহজসাধ্য সেবা দিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বর্তমানে অনলাইন ও টেলিফোনে বিভিন্ন সেবা দিচ্ছে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, বিডার ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস)’ পোর্টালে এখন পর্যন্ত ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের মোট ১৩৪টি সেবা দেওয়া হচ্ছে। দেশজুড়ে সব বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবার একটি মানচিত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং সেগুলো ধাপে ধাপে ওএসএসের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো (বিএসডব্লিউ)’ চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আবেদন, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবা একই প্ল্যাটফর্মে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তিনি আরও জানান, বিএসডব্লিউ ইতোমধ্যে বিভিন্ন সার্টিফিকেট, লাইসেন্স ও অনুমতিপত্র প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, তাদের অন্যতম অগ্রাধিকার একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন। এই লক্ষ্যেই নির্বাচনী ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার শুরু করা হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভিত তৈরি করবে। তিনি বলেন, গত দেড় দশকে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই আইনি কাঠামো, নীতিমালা ও প্রশাসনিক আদেশ সংস্কার করে আমরা আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই।
সালেহউদ্দিনের ভাষায়, এ বাজেট কেবল আর্থিক পরিকল্পনা নয়, এটি একটি রূপান্তরের রূপরেখা। আমাদের লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করা।অর্থ উপদেষ্টার আশা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় তৈরি’ এ বাজেট ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই সমাজ গড়ে তোলার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে।
তিনি বলেন, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোনো রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যে সকল সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।