সরকারকে যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে : ব্রি: সাখাওয়াত

ক্নগদ অর্থ ব্যবহারের প্রবণতা কমিয়ে আনতে হবে : বাংলাদেশ ব্যাংক

অর্থনৈতিক উন্নতি করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল : আমীর খসরু মাহমুদ

ব্যাংকখাত সংস্কারের ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে : সিপিডি নির্বাহী পরিচালক

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সংলাপে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও সংস্কারের ফলে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা তুলে ধরে তারা বলেন, এখন সবাই মন খুলে কথা বলতে পারছে। কাউকে গুম, খুন করা হচ্ছে না।

গতকাল রবিবার রাজধানীর গুলশানে এক হোটেলে আয়োজিত সিপিডি সংলাপে এসব কথা বলেন তারা। সিপিডির সংলাপের বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ।

শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন,আমরা পলিটিকাল ইকোনমির কথা তো অনেক বলছি এটাও পলিটিকাল ইকোনমির তথ্য। একটা গার্মেন্ট কোম্পানি টোটাল ৪৮ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা পার্টিকুলারলি ১৬টা ব্যাংক এবং সাতটি ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি থেকে নিয়ে গেছে। কোথায় টাকা কেউ জানে না। ট্রাই করছি মানি ব্যাক করতে। (এর মধ্যে) একটা ব্যাংকের আমি নাম নিচ্ছি। একটা ব্যাংক- জনতা ব্যাংক। এখান থেকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে।

জনতা ব্যাংক সেই গার্মেন্টে কীভাবে অর্থায়ন করেছে, তার সদুত্তর মেলেনি বলে জানান উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন। তিনি মনে করেন, এমন পরিস্থিতির জন্য ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রকদেরই দায় বেশি।

তিনি বলেন, কোথাও শুনেছেন যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মত স্টেট ব্যাংকের গভর্নর পালিয়ে যায়? বাংলাদেশের তিনজনকে পাওয়া যাচ্ছে না । ইনক্লুডিং গরিবের ব্যাংকার মানে গরিবের গভর্নর ছিলেন, উনিও পলাতক।

শ্রম উপদেষ্টা বলেন, এভাবে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাঠামো বিগত আমলে ভেঙে পড়েছিল। আর যখন তিনি দায়িত্ব নেন, তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল নাজুক। থানা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ কাজে ফিরতে অনাগ্রহী ছিল।

তিনি বলেন, এ অবস্থার মধ্যেও উই ট্রাই আওয়ার লেভেল বেস্ট। গালি খাচ্ছি আর খাচ্ছি। ইউটিউব ওপেন, যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে। আর এগুলো হজম করতে হচ্ছে। অ্যান্ড আই ডোন্ট হ্যাভ মাই ওয়ার্কার যে- ‘যা ওরে পিটায়া দিয়ে আয়’। তাই চুপচাপ হজম করতে হচ্ছে। শুনতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, অনেকেই বলে, ‘স্যার, ওটা আপনাকে বলছে’। আমি বলি, কিছু করার নাই। লেট দেম ডু ইট। যাই হোক আমরা চেষ্টা করছি । যদি ফেইলিউর হয়ে থাকি, তাহলে আমার একার ফেইলিউর না; আপনাদেরও ফেইলিউর আছে।”

অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার কথা বলতে গিয়ে সাখাওয়াত বলেন, এখন সবাই মন খুলে কথা বলতে পারছে; কাউকে গুম, খুন করা হচ্ছে না।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বেশ কয়েকজন শিল্প মালিক যারা ব্যর্থ মালিক, তাদের সম্পত্তি এখন আমার মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে। তাদের বাড়ি, তাদের দলিল নিয়ে আসা হয়েছে। এখন রেডি টু সেল। দুই-চার দিনের মধ্যে একটু বিক্রি হবে। কারণ ওয়ার্কারদের সেন্ট্রাল ফান্ড থেকে লোন দেওয়া হয়েছে। এই করে করে চেষ্টা হচ্ছে তাদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে।

তিনি বলেন, আমার যে স্টাডি, এটা হচ্ছে যে এইসব লোক টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে। কোথাও টাকা-পয়সা নাই। টাকা-পয়সা নিয়ে বিদেশে থাকছে অথচ শ্রমিকের বেতন দিতে পারেন না। এটা এই সময়ের না, গত দুই বছর-তিন বছর আগের।

তিনি বলেন, আমরা আসার আগে থেকে শ্রমিকরা বেতন পাবেন না, কিন্তু শ্রমিকরা কোনো কথাও বলতে পারে নাই। কথা বললে গুম, না হয় জেল, না হয় গুলি। ৪২ জন শ্রমিক নেতা জেলের মধ্যে ছিল (অন্তর্বর্তী সরকার আসার সময়)। এখন মাত্র একজন আছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ঐকমত্যের প্রচেষ্টা একটি ভালো উদ্যোগ। আলাদা দর্শন থাকবে, কিন্তু সবাইকে এক জায়গায় আসতে হবে এটা বাকশালের আদর্শ। চাপিয়ে দিয়ে পরিবর্তন আনতে চাইলে, সেই সিদ্ধান্ত টেকসই হবে না। অর্থনৈতিক উন্নতি করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ, সারা দেশে পরিবহন ও বণ্টনে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের এ বিপুল খরচ বাঁচাতে হলে নগদ অর্থ ব্যবহারের প্রবণতা কমিয়ে আনতে হবে। ক্যাশলেস বা নগদ অর্থ ছাড়াই লেনদেন বাড়াতে হবে।

গভর্নর বলেন, প্রতিবছর টাকা ছাপানো, পরিবহন ও বণ্টনে বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ হয়। এ খরচ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেন জনপ্রিয় করতে নীতিগত সহায়তা ও প্রযুক্তি অবকাঠামো তৈরির কাজ করছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কিউআর কোড ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা সবার জন্য লেনদেন হবে দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ। ক্যাশের ব্যবহার কমলে রাষ্ট্রীয় খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।

সংলাপে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য স্মার্টফোনের গুরুত্ব তুলে ধরেন আহসান এইচ মনসুর। বর্তমানে আর্থিক লেনদেন, বিল পরিশোধ বা ইন্টারনেটভিত্তিক যেকোনো সেবা নিতে স্মার্টফোনের ব্যবহার অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা স্মার্টফোনের দাম কমাতে কাজ করছেন। ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের স্মার্টফোন বাজারে আনতে পারলে শতভাগ মানুষকে স্মার্টফোনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

গভর্নর আরও বলেন, এ লক্ষ্য অর্জনে ইন্টারনেটের দাম আরও কমাতে হবে এবং সেবার মান বাড়াতে হবে।

নগরায়ণ ও আবাসন খাতের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে এখনো কয়েক মিলিয়ন নতুন আবাসনের প্রয়োজন রয়েছে। নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। কেননা, মানুষ গ্রামে ফেরত যাবে না। তাই সাশ্রয়ী আবাসন পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা জমি ডেভেলপারদের সঙ্গে অংশীদারত্বে ব্যবহারের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, স্বৈরাচারের পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন বুঝতে না পারলে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি টিকতে পারবে না।

তিনি বলেন, বক্তব্যের মাধ্যমে বিষোদগার বন্ধ করতে হবে। গণতন্ত্র মানে অন্যজনের কথা শুনে সহ্য করা, তার মতকে সম্মান দেওয়া। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে সংস্কার অসম্ভব। বিপ্লবোত্তর যে দেশ দ্রুত নির্বাচন করেছে, তারা ভালো করেছে; যারা দীর্ঘ সময় নিয়েছে, সেখানে অন্তঃকোন্দল বেড়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে। এটা একটি অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব যেখান থেকে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, সেখান থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা। জনগণকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে।

এই সরকারের সময় বিনিয়োগ আসেনি মন্তব্য করে বিএনপির এই নেতা বলেন, এতে তাদের দোষ নেই। বিনিয়োগে বাংলাদেশ অনেক নিচে। সিরিয়াস ডিরেগুলেশন ও সিরিয়াল লিবারেলিজম ছাড়া দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, সরকারের অনেক দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। ট্রেড বডিগুলোর হাতে অনেক কার্যক্রম তুলে দিয়ে সরকারকে নির্ভার হতে হবে। ফিজিক্যাল কন্ট্রাক্ট না কমালে দুর্নীতি কমানো যাবে না। দেশে যত নিয়ন্ত্রণ (রেগুলেশন) থাকবে, তত দুর্নীতি বাড়বে। অর্থনীতিকে গণতান্ত্রিক করতে হবে, সবার অংশগ্রহণ লাগবে।

তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদের বাজেট চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দেওয়া উচিত ছিল।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক খাত সংস্কার অন্যতম উদ্যোগ। এর ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটা ভালো অবস্থায় গেছে, পতন ঠেকানো গেছে।

একটা বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করা গেছে। এটা একটা অন্যতম সাফল্য। এর পাশাপাশি এটাও জানি মূল্যস্ফীতি উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগ আসছে না, কর্মসংস্থান হচ্ছে না। রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। সুতরাং এই বিষয়গুলো আগামী ৬ মাস ও নতুন সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।

দরিদ্র মানুষদের স্বস্তি দেওয়ার কর্মসূচি চলমান রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজও চলমান থাকা প্রয়োজন। কারণ, এখনো মূল্যস্ফীতি যথেষ্ট উপরে রয়েছে। বিনিয়োগে স্থবিরতা এসেছে, এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নতুন করে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো প্রস্তুত করলে আগামীতে যারা সরকারে আসবে তখন বিনিয়োগকারীরা সহজেই বিনিয়োগ করতে পারেন।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ৫ থেকে ৬ মাসে নতুন করে সংস্কার কাজ কতখানি বাস্তবায়ন হবে; সংস্কারের যে সুপারিশমালা রয়েছে, তা কতখানি বাস্তবায়ন হবে তা বলা যাচ্ছে না। সংস্কারের জন্য যে পদক্ষেপ; এই পর্যন্ত সেটা কিন্তু ধীর গতিতে ছিল।