পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করার পাশাপাশি বাংলাদেশে বেআইনী পুশ ইন বাড়িয়েছে ভারত। স্থল সীমানার পাশাপাশি বন এবং সাগর পথেও পুশ ইন অব্যাহত রেখেছে ভারতীয় বাহিনীগুলো। পুশ ইনের আগে তাদের ওপর অমানুষিক এবং অমানবিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগীরা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিবাসীদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এহেন বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে দিল্লিকে চিঠি দিয়েছে। চলতি মাসেই পুশ ইনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী বিএসএফ। ঘন ঘন পুশ ইনের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যেও।
বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ-বিজিবি, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের সীমানায় 'পুশ ইন' করা অর্থাৎ জোর করে ঠেলে দেওয়া এসব মানুষের ভেতর বাংলাদেশী নাগরিকদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিকরাও আছেন।
গত ৯মে শুক্রবার সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জনকে ফেলে যায় বিএসএফ। পুলিশ বলছে, এদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশী ও তিনজন ভারতীয় নাগরিক। উদ্ধারকৃতদের বরাত দিয়ে পুলিশ এও জানিয়েছে যে, তাদের গুজরাট থেকে উড়োজাহাজে-লঞ্চে করে চোখ বেঁধে আনা হয়েছে, অনেকে অসুস্থ এবং কারও কারও শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন আছে।
এর আগে ৭ মে বুধবার পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পুশ ইন করানোর পর ১২৩ জনকে আটক করে বিজিবি। তাদের ভেতর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা, শান্তিপুর ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তিরাও জানান, তাদের গুজরাট থেকে বিমানে করে প্রথমে ত্রিপুরায় নিয়ে আসেন বিএসএফ সদস্যরা। তারপর এক ঘণ্টা হাঁটিয়ে সীমান্ত দিয়ে এ পারে ঠেলে দেওয়া হয়। এই অনুপ্রবেশকারীদের ভেতর বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও রোহিঙ্গা ও গুজরাটি ভাষায় কথা বলা মানুষও ছিল বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের নাগরিক বলে ভারত যেভাবে এত এত মানুষকে সীমান্তের এপারে ঠেলে দিলো তা কতটা যুক্তিসঙ্গত? বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এমন একটি সংবেদনশীল ও জটিল ইস্যুতে কেন আনুষ্ঠানিক কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না? আর পুশ ইনের জন্য ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলা এমন যুদ্ধকালীন একটি সময়কেই বা কেন বেছে নেওয়া হলো? এর মাধ্যমে ভারত কী বার্তা দিতে চাইছে বাংলাদেশকে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশেরই বা করণীয় কী ?
পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গত কয়েক দিনের পুশ ইনের পদক্ষেপগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; যা গভীর উদ্বেগের একটি বিষয়। এটি চূড়ান্তভাবে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে এবং জনমনে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইসিএইচআর) অভিযোগ করেছে- ভারতীয় নৌবাহিনী গত সপ্তাহে তাদের একটি জাহাজ থেকে ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমার উপকূলের কাছাকাছি আন্দামান সাগরে ফেলে দেয়। তাদের নয়াদিল্লি থেকে আটক করা হয়। ওই শরণার্থীদের মধ্যে শিশু, নারী ও বৃদ্ধরাও ছিলেন। তাদের একটি বিমানে করে নিয়ে যাওয়ার পর ৮ মে ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা তাদের লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেয়।
সম্প্রতি সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) রেখে যায় ৭৮ জনকে। তারা তাদের ওপর অত্যাচারের লৌমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। তারা বলছে সুন্দরবনে ফেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের ‘মারধর’ করাসহ নানাভাবে ‘অমানবিক আচরণ’ করা হয়। তাদের দাবি, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আটকে রাখার সময় তাদের নামমাত্র বিস্কুট ও পাউরুটি দেওয়া হয়েছে। এমনকি পানিও দেওয়া হয়েছে খুবই সামান্য। টয়লেটে যাওয়ার কথা বললে অধিক নির্যাতন করা হতো। পশ্চাৎদেশে ভারতের সিল মেরে দিয়ে পেটানো হতো বলেও অভিযোগ তাদের। কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে পিছমোড়া করে দুই হাত বেঁধে অন্যদের সঙ্গে বিমানে তোলা হয়। পরে ৬ তারিখে জাহাজে তুলে ব্যাপক মারধর করা হয়। রাত ১২ টার পর শরীরে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে বঙ্গোপসাগরের চরে ফেলা হয় তাদের।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ওএইসিএইচআর এক বিবৃতিতে ঘটনাটিকে অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য কাজ বলে উল্লেখ করে এ ঘটনার তদন্তের জন্য জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছে বলে জানানো হয়। সংস্থাটি ভারত সরকারকে আহ্বান জানায়, ভারত যেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি অমানবিক ও প্রাণঘাতী আচরণ থেকে বিরত থাকে।
পরিসংখ্যান বলছে চলতি মে মাসের এই কয়দিনে সিলেট, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে প্রায় ৪শ’ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে। পুশ ইন ঠেকাতে বাংলাদেশের সীমান্তবাহিনী বিজিবি’র পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারাও রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন।
রিফিউজিস ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বসবাসরত আনুমানিক ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে অন্তত ২২ হাজার ৫০০ জন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাওএইসিএইচআর-এর নথিভুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা নির্যাতন ও হামলার শিকার হয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের ভারত থেকে বিতাড়নের দাবি জানিয়ে আসছে।
প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিটি কেস আলাদা আলাদাভাবে নিরীক্ষণ করছি। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের দেশের নাগরিক যদি কেউ হয়ে থাকেন, আর সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের আমরা গ্রহণ করব। তবে এটা ফরমাল চ্যানেলে হতে হবে। এভাবে পুশ ইন করাটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ভারতকে অবিলম্বে এ ধরনের কর্মকা- বন্ধের আহ্বান জানানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক চিঠিতে। ওই চিঠিতে বলা হয়, 'বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এই ধরনের পুশ ইন গ্রহণযোগ্য নয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ভারত থেকে পুশ ইনের মাধ্যমে আসাদের মধ্যে বাংলাদেশী থাকলে তাদের পুশ ব্যাক করার সুযোগ নেই। তবে ভারতের নাগরিক ও দেশটির রোহিঙ্গারা থাকলে তাদের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার ফেরত পাঠানো হবে।
জনগণ ও সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতে টহল জোরদারের কথা জানিয়েছেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, আমাদের সীমান্ত অনেক বিস্তৃত হওয়ার কারণে প্রতিটি স্থানে পাহাড়া দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আনসার বাহিনীর সাহায্য নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জনগণেরও সাহায্য প্রয়োজন।
কূটনীতিক ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরও বলেন, 'ওরা [ভারত] যদি মনে করে যে বেআইনিভাবে ওখানে কেউ আছে যারা বাংলাদেশী; তাহলে বাংলাদেশের কাছে ইনফরমেশন পাঠাবে। বাংলাদেশ সরকার সেটা যাচাই করে ইয়েস অর নো কিছু একটা বলবে। আইনটা এমনই আছে। যদি দেখা যায় যে তারা বাংলাদেশী, তাহলে বিএসএফের মাধ্যমে তাদেরকে বর্ডারে আনা হলে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাদের বুঝে নেবে। এটাই নরমাল প্রসেস।'
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বিষয়টি নিয়ে প্রথমেই বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে পতাকা বৈঠক হওয়া দরকার। এ বিষয়টাও ভালো করে দেখা দরকার যে, কারা কোন দেশের নাগরিক। যদি তাদের কেউ বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায়িত্ব হবে তাদের বুঝে নেওয়া। আর যদি তারা বাংলাদেশের নাগরিক নাও হয়ে থাকেন, তাহলে ওই ফ্ল্যাগ মিটিংয়েই বলা উচিত যে তারা বাংলাদেশের নাগরিক না।
বিশ্লেষকরা বলেন, 'একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে কেউ যদি সীমান্ত দিয়ে কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়া, নোটিশ ছাড়া দলে দলে মানুষকে পুশ ইন করে, যেকোনো দেশের সরকারই এটাকে পুশ ব্যাক করবে। তাহলে বাংলাদেশের সামনে বিকল্প হলো পুশ ব্যাক; যেটা আপাতদৃষ্টিতে অমানবিক। কিন্তু বাংলাদেশ তো একটা রাষ্ট্র। ফলে এখন পুশ ইন-পুশ ব্যাক দুটোই যদি শুরু হয় তাতে সীমান্তে একটা সামরিক উত্তেজনা তৈরি হবে। আর ভারতের এটা অনুমান না করার কোনো কারণ নেই যে, তারা যেটা করছে সেটা সামরিক উত্তেজনা তৈরির প্রথম পদক্ষেপ।