আবাসিক হোটেল-মেস ও স্বজনদের বাসায় অবস্থান
টাকার জোগান আসছে দেশ-বিদেশ থেকে
নিষিদ্ধ দলের নেতা-কর্মীদের তথ্য চেয়েছে পুলিশ
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গোপনে ঢাকায় জমায়েত হয়ে ঝটিকা মিছিল করে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা রাজধানীতে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়ার চেষ্টা করছে। জেলা-উপজেলা থেকে শত শত নেতাকর্মী ঢাকা ও আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় এসে আত্মগোপন করে আছেন। নিষিদ্ধ দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছেন। রাজধানীতে তারা আত্মীয় স্বজনদের বাসায়, বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, মেস ও পরিচিত জনদের সাথে অবস্থান করছেন। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সুযোগ বুঝে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এমন তথ্য রয়েছে।
গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, নিষিদ্ধ দলের নেতাকর্মীরা শুধু ঝটিকা মিছিল নয়, ককটেল বিস্ফোরণ, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা এবং অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালানোরও পরিকল্পনা করছে। তারা পরিচয় আড়াল করে সহযোগী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলনোর চেষ্টা করছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের জেলখানায় থাকা শীর্ষ কয়েকজন নেতা, দলের স্থানীয় এবং বিদেশে থাকা নেতারা এসব তৎপরতা চালানোর নির্দেশনা দিচ্ছেন। এমনকি তাদেরকে অর্থেরও যোগান দিচ্ছেন শীর্ষ নোতারা। আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দলটির নেতা-কর্মীরা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বিদেশে পাচারের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে তাদের শত শত কোটি টাকা জমা রয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু এমনকি দলের নেতাকর্মীদের নামেও বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে অঢেল টাকা। ব্যাংক ছাড়াও অনেকের টাকা নিজেদের বাসা-বাড়ি ও গোপন স্থানে জমা রয়েছে। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর ঝালকাঠিতে সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বাসভবন থেকে প্রায় চার কোটি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। শহরের রোনালস রোডের আমুর বাসভবন থেকে লাগেজভর্তি টাকাগুলো উদ্ধার করা হয়। এধরণের অনেক নেতার কোটি কোটি টাকা নিজেদের কাছে গচ্ছিত রয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাসে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নামে তেমন কোনো তৎপরতা না থাকলেও তারা ছদ্মবেশে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। তবে সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রম বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের দোসররা এমনিতেই ভয়ে পালিয়ে যান। শুরুর দিকে সাংগঠনিকভাবে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা না হলেও কার্যত জনগণের কাছে তারা নিষিদ্ধই ছিলেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে দেশের কয়েকটি স্থানের পাশাপাশি ঢাকার দুই-এক জায়গায় ভোরের দিকে আওয়ামী নেতা-কর্মীদের মিছিলের সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু চলতি সেপ্টেম্বর মাসে সকাল, দুপুর, বিকেল প্রায় সময়েই ঢাকায় রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই কার্যক্রম প্রতিরোধে শুধু গ্রেপ্তার নয়, জমায়েতের শুরুতেই ব্যবস্থা নিতে হবে। গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ রকম মাস্টার প্ল্যান নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে কাজ করতে হবে। পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, এলাকায় এলাকায় থানা পুলিশের টহল ডিউটির পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের গোয়েন্দা সদস্য ও র্যাবের গোয়েন্দারাও নজরদারিতে থাকেন। এত নজরদারির পরও সাংগঠনিকভাবে নিষিদ্ধ একটি সংগঠন কীভাবে প্রকাশ্যে মিছিল করতে পারে, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
তিনি বলেন, গত মঙ্গল ও বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ২৪৪ নেতাকর্মী গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে ঝটিকা মিছিল আয়োজনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির পায়তারা করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে ডিএমপির সকল ইউনিটের চেষ্টায় এদের গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ৫০ জনকে, সিটিটিসি ২৭ জনকে, তেজগাঁও বিভাগ ১০০ জনকে, রমনা বিভাগ ৫৫ জনকে, গুলশান বিভাগ ৫ জনকে, মিরপুর বিভাগ ৪ জনকে এবং উত্তরা বিভাগ ৩ জনকে গ্রেফতার করে। স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এই গ্রেফতারের সময় ১৪ টি ককটেল ও ৭ টি ব্যানার উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, ঝটিকা মিছিল বাবদ অর্থায়ন করছে দেশে ও দেশের বাইরে পালানো আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা। অর্থের লোভে অনেকে ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকা আসছেন। তাদের হোটেল, পালানো আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের ফাঁকা ফ্ল্যাট, হোটেল, মোটেলে রাখা হচ্ছে।
সম্প্রতি ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন নজরুল ইসলাম জানান গ্রেপ্তার অনেকেই জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন- টাকার বিনিময়ে ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণ করছেন তারা। কোন কোন দেশ থেকে ঝটিকা মিছিলের অর্থ আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সংগঠিত হচ্ছে, অপতৎপরতা চালাচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে। প্রথমদিকে তারা ভোরের দিকে যখন রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকতো তখন মিছিল করতো। এরপর সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে রামপুরার দিকে মিছিল করে। এরপর বিমানবন্দরের গোল চত্বরের দিকে মিছিল করে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা সাহস সঞ্চার করছে, মিছিলের উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে এবং দেশের বাইরে থেকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা শক্তি সঞ্চার করছে। এক্ষেত্রে পুলিশ ব্যর্থ কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটেই এমন নয়। এক বছর আগে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। তারা টানা সাড়ে ১৫ বছর এ দেশে ক্ষমতায় ছিল। তাদের বিরাট জনগোষ্ঠী, বিরাট সাপোর্টার আছে। তাদের দলের এক শতাংশ নেতাকর্মী হয়তো দেশের বাইরে আছে, বাকিরা কিন্তু দেশেই আছে। সেই তুলনায় মিছিল-মিটিং কর্ম তৎপরতা নিহায়েত কম। বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় আছে বিধায় অপতৎপরতা রোধ করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, দু’ একটি মিছিল হবে না, শতভাগ সিল করে দেওয়া যাবে- তা আমাদের জন্য কিছুটা দুঃসাধ্য। তারপরেও পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ডিএমপির এই অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, ঢাকার আবাসিক হোটেল, ফ্ল্যাট ও ছাত্রাবাসে নিয়মিত রেইড দেওয়া হয় এবং গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। তবে সব সময় পারা যায় না। ঢাকা শহর অনেক জনবসতিপূর্ণ। অনেক ফ্ল্যাট এখন ফাঁকা। এমনকি অনেক আওয়ামী নেতাকর্মীর ফ্ল্যাটও ফাঁকা। তাদের আত্মীয়-স্বজনের ফ্ল্যাটও ফাঁকা আছে। আমাদের কাছে তথ্য আসছে- এই সমস্ত বাসা-বাড়িতে গ্রাম থেকে অনেক নেতাকর্মী ফ্রি থাকছেন। একটি বিল্ডিংয়ে ১০-২০টা ফ্ল্যাট রয়েছে, সেখানে দুটি ফাঁকা ফ্ল্যাট রয়েছে। সন্দেহভাজন ভবন-ফ্ল্যাটের তথ্য পুলিশকে দিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে অপরিচিত মানুষদের দেখা যায় -এমন তথ্য আমাদের দিলে পুলিশের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এই তথ্যগুলো পুলিশকে দিলে শতভাগ তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখা হবে। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও করতে পারেন যেকেউ। ভাড়াটিয়া তথ্য পুনরায় নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি ডিএমপির সিআইএমএস আলাদা সফটওয়ারে আছে। গত মাসেও প্রায় ৫০ হাজার ভাড়াটিয়ার তথ্য হালনাগাদ করা হয়েছে। তথ্য হালনাগাদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ঝটিকা মিছিল থেকে উদ্ধার ককটেল নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, ককটেল থেকে এখন পর্যন্ত বিপদজনক কিছু হয়নি। প্যানিক বা মেসেজ দেওয়ার জন্য মিছিলে ককটেল রাখা হয়। ককটেল নিয়ে বোম ডিজপোজাল ইউনিট পরীক্ষা করে দেখেছে এক্সপ্লোসিভ কিছু নেই। ম্যাচের কাঠির সালফার, পাথর ও সাইকেলের চাকার বল দিয়ে বানিয়ে সাউন্ড ও ধোঁয়া তৈরি করে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মিছিল ঠেকাতে না পেরে দায়িত্বে অবহেলার জন্য কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত শুক্রবার আমাদের কাছে তথ্য ছিল নামাজের পর দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বড় ধরনের মিছিল হতে পারে। এজন্য মোবাইল পেট্রোলসহ সব অফিসারদের মাঠে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজনে খাওয়ার জন্যও পালাক্রমে থানায় এসে খেয়ে যাবে। মনিটর করার জন্য ডিএমপির সিনিয়র অফিসার মাঠে ছিল। আমি নিজেই বিকেলের দিকে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখি ওসি, জোনাল অফিসার, ইন্সপেক্টর (অপারেশন)সহ কয়েকটি টিম থানায় অবস্থান করছে। তারা সিনিয়র অফিসারের নির্দেশনা অমান্য করেছে। এজন্যই তাদের ডিএমপির সদর দপ্তরে ক্লোজ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের ঘটনার পরপরই কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিলেও পুলিশ এখন সম্পূর্ণ সক্ষম। শুরুতে মফঃস্বল শহর থেকে এসে ডিএমপিতে কাজ করতে যেয়ে দেখে ঢাকার অনেক রাস্তাঘাট তারা চেনে না। এক বছর তারা পার করেছেন, তারা এখন রাস্তাঘাট চেনা। এখন পুলিশ বাহিনী পরিস্থিতি সামলাতে সক্ষম। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠনের যে কোনো অপতৎপরতা রোধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান এস এন নজরুল ইসলাম।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঝটিকা মিছিল থেকে আটক হলেও দ্রুত জামিনে বের করার জন্য আদালতে আইনি লড়াই করতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা প্রস্তুত রয়েছেন। তারা নিম্ম ও উচ্চ আদালতে অল্প সময়ে এদের জামিনে বের করে আনবে বলেও আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন। সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময়ে যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে। জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার নিষিদ্ধ দলের ঝটিকা মিছিলে অংশ নিচ্ছে।