ঈদুল ফিতর সামনে রেখে জমে উঠেছে রাজধানীর মার্কেটগুলো। এরই মধ্যে জাল নোট তৈরি ও সরবরাহ করতে সক্রিয় হয়ে উঠছে চক্রের সদস্যরা। চক্রটি ঈদকে সামনে রেখে এক হাজার ও পাঁচশত টাকার জাল নোট তৈরি এবং সরবরাহ করতে তোড়জোর শুরু করেছে বলে তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। পুরিশ জানায়, ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের বাজারে জাল নোটের কারবারিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। কেনাকাটার ভিড়ে অসতর্কতা কিংবা ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে প্রতারকচক্র আসল নোটের সঙ্গে জাল টাকাও চালিয়ে দেয়। বিশেষ করে রমযানের শেষদিকে বিপণিবিতানগুলোতে এই প্রবণতা বাড়ে।

ছোট নোটের পরিবর্তে অধিক লাভের আশায় জালনোট চক্র এক হাজার টাকার নোট তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যে জালনোটসহ কয়েকজনতে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ এসব তথ্য নিশ্চিত হয়। এধরনের আরও কোনো চক্র জাল টাকা তৈরি করছে কিনা, বা কোনো চক্র জাল নোট বাজারে ছেড়েছে কিনা এ বিষয়ে মাথায় রেখে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীর, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনিচক, মৌচাক, গুলিস্তান মার্কেট ছাড়াও বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্কসহ বড় বড় শপিং মলে ঈদ কেনাকাটার ভিড়ে প্রতিদিন চক্রগুলো সক্রিয় থাকে জালনোট ছড়িয়ে দিতে।

তদন্তকারীরা বলছেন, দ্রুত নিখুঁত জাল নোট তৈরি করতে বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা। তারা এখন পাঁচ শ ও এক হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ৫০ টাকার নোটও জাল করছে। জামিনে থাকা আরো কিছু চক্র জাল নোট ছাড়ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জাল নোট তৈরির চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর তারা জামিন নিয়ে এসে ফের এই ব্যবসায় জড়ায়। তাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খোদ আইনজীবীও। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের মাধ্যমে জাল নোট চক্রের সদস্যরা ধরা পরার পর সহজে জামিনে এসে ফের জাল নোট তৈরি করে বাজারজাত করছে। শুধু তাই নয়, চক্রটি অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে পার্সেলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জাল নোট পৌঁছে দিচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মিডিয়া তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, রময়ানের ঈদকে সামনে রেখে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র জাল নোট তৈরী বিক্রি শুরু করছে। এমন খবরের ভিত্তিতে গত রোববার রাতে রাজধানীর ওয়ারি এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অভিযান চালিয়ে ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৬০০ টাকার জাল নোট ও ৭৭ হাজার ১শ টাকার ভারতীয় রুপির জাল নোট ও সরঞ্জাম উদ্ধার করছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলো, সাইদুর রহমান ও মেহেদী হাসান। ডিবির কর্মকর্তা জানান,গোপন খবরের ভিত্তিতে পুরনো ঢাকার আর কে মিশন রোডের ৮ নং গলির একটি ভবনের ৬ষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাটে ডিবি উত্তর বিভাগের টিম অভিযান চালাতে যান। অভিযানের সময় জাল নোট ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান ও মেহেদী হাসানকে গ্রেপ্তার করে। অন্যজন পালিয়ে গেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের হেফাজত থেকে এক হাজার ও ৫শ টাকা মূল্যের মোট ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৬শ টাকার জাল নোট,৭৭ হাজার ১শ ভারতীয় রুপির জাল নোট,একটি সিপিইউ,একটি মনিটর,জাল নৈাট তৈরীতে ব্যবহ্নত প্রিণ্টারের আটটি অব্যবহ্নত কালির কোটা, ১শ পিস ফয়েল পেপার (সিকিউরিটি ফিতা) ২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ওয়ারি থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ডিবির কাছে স্বীকার করে বলেছে, গ্রেপ্তারকৃতরা অবৈধ ভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের দেশী ও বিদেশী জাল নোট তৈরী করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রয় করত। তারা আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে বিপুল পরিমান জাল নোট তৈরী করে সেগুলো সরবরাহ করার জন্য তাদের হেফাজতে রেখেছিল। বলে ডিবির কাছে স্বীকার করেছে বলে ডিবি দাবি করছেন। এর আগেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর টিম রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল নোট উদ্ধার করছে। একের পর অভিযানে টাকা উদ্ধার হলেও জালিয়াত চক্র এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা অভিজাত ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে এখন জাল টাকা তৈরী করছে। ডিবির টিম পলাতক জাল নোট তৈরীকারি চক্রকে ধরতে অভিযানে নেমেছে।

এর আগে গত শনিবার রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ টাকার জাল নোট এবং জাল নোট তৈরির সরঞ্জামসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- সুমন (৩৮), সুলতানা (২৮) ও হানিফ গাজী (৪৮)। তাদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকার জাল নোট, আংশিক ছাপানো ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকার জাল নোট এবং জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, গত বৃহস্পতিবার তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। কামরাঙ্গীরচর থানা সূত্রে জানা যায়, জাল নোটের ব্যবসায়ীদের ধরতে বৃহস্পতিবার দুপুরে মাদবর বাজারের বুড়িগঙ্গা গণপাঠাগার সমাজকল্যাণ সংস্থার সামনে বেড়িবাঁধে চেকপোস্ট বসায় পুলিশ। দুপুর দেড়টার দিকে একটি অটোরিকশায় জাল টাকার ব্যবসায়ীরা সেখানে পৌঁছালে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরে সুমন, সুলতানা ও হানিফ গাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেহ তল্লাশি করে ১০০০ ও ৫০০ টাকার মোট চার লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলীর গ্যাস লাইন এলাকায় সুমনের ভাড়া বাসা থেকে ১৬ লাখ টাকার জাল নোট, একপাশে ছাপানো ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকার জাল নোট, একটি সিপিইউ, একটি মনিটর, একটি কালার প্রিন্টার, জাল নোট তৈরির ১০টি ডাইস, তিনটি আঠার কৌটা, দুটি ফয়েল পেপার রোল, পাঁচটি কালির কৌটা, একটি রাবার কাটার, দুটি কাগজ ছিদ্র করার ভাইস ও জাল নোট তৈরির কাজে ব্যবহৃত এক বস্তা সাদা কাগজ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের জাল নোট তৈরি করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করত। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি করে সেগুলো সরবরাহের জন্য রেখেছিল বলে তারা স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে কামরাঙ্গীরচর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জাল নোট তৈরি ও বিক্রির অভিযোগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

যেভাবে চিনবেন জাল নোট: বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, জাল নোট তৈরি ও ছড়ানোর একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় থাকে। তারা সাধারণত কাঁচা বাজার, বাসস্ট্যান্ড, গরুর হাট, শপিং মল ও ফুটপাতের দোকানগুলোকে টার্গেট করে। ঈদের সময় নতুন নোটের চাহিদা থাকায় প্রতারকরা হুবহু নতুন নোটের মতো দেখতে জাল টাকা তৈরি করে বাজারে ছাড়ে।

নিরাপত্তা সুতা: ১০০, ২০০ ও ৫০০ টাকার নোটের বাঁ পাশে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ৪ মিলিমিটার, ১০০০ টাকার নোটে ৫ মিলিমিটার চওড়া অনেকটা মাথায় বেণির মতো প্যাঁচানো নকশার নিরাপত্তা সুতা আছে। ১০০, ২০০ ও ৫০০ টাকার নোটের সুতার এক অংশ ক্রমে লাল হতে হতে সবুজ রঙে পাল্টে যায়। আর অন্য অংশে ছাপানো থাকে টাকার মান। ১০০০ টাকার নোটের সুতার এক অংশ ক্রমে সোনালি থেকে সবুজ রঙে পরিবর্তন হয়। ২০০ ও ১০০০ টাকার নোটের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সুতার অংশে নোটের মান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ছাপানো আছে। নোটগুলো নাড়াচাড়া করলে হলোগ্রাফিক ইমেজের চকচকে ভাব চোখে পড়ে। নকল টাকার ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয় না।

লুকানো ছাপার অক্ষর: ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের যে পিঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি আছে, তার নিচের অংশে মাঝখানে বিভিন্ন নকশার আড়ালে ১০০, ৫০০ ও ১০০০ সংখ্যাটি ছাপানো আছে। নোটটি একটু কাত করে ধরলে এসব সংখ্যার উপস্থিতি বোঝা যায়। আর ২০০ টাকার ওই অংশে ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে (ঞডঙ ঐটঘউজঊউ ঞঅকঅ)।

খুব সূক্ষ্ম ফন্টে (অক্ষরে) লেখা: ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের পেছনের পিঠের নিচের দিকে বাঁ পাশে ১০০, ৫০০ ও ১০০০ সংখ্যা মানের সঙ্গে ইঅঘএখঅউঊঝঐ ইঅঘক লেখা আছে। ২০০ টাকার নোটের এক্কেবারে বাঁ পাশের নকশার মাঝে মাঝে অতি ছোট্ট অক্ষরে ২০০ লেখা আছে। তবে এতটাই সূক্ষ্ম সেই অক্ষর যে খালি চোখে দেখা মুশকিল। আতশী কাচ বা উন্নতমানের স্মার্টফোনের ক্যামেরা নোটের ওপর ধরে যথেষ্ট পরিমাণ জুম করলে দেখা সম্ভব। জুম করলেও এই সূক্ষ্ম ফন্ট ফাটবে না, কিন্তু নকল টাকার ক্ষেত্রে ফেটে যাবে।

খসখসে ভাব: সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার সাইফুল ইসলাম জানান, খালি চোখে জাল টাকা শনাক্ত করা একটু জটিলই বটে। তবে খুব সহজ একটি উপায় হলো স্পর্শ। হাতে নিয়েই বোঝা যায়! আসল নোট কিছুটা খসখসে হয়। অন্য দিকে ছাপানো জাল টাকা মসৃণ থাকে।

লেখায় রঙের পরিবর্তন: ১০০ ও ১০০০ টাকার নোটের এদিক-ওদিক পরপর মেলে ধরলে প্রতি কোনায় থাকা সংখ্যার রং হয় সোনালি থেকে সবুজ এবং ৫০০ টাকার ক্ষেত্রে রং হয় ম্যাজেন্টা থেকে সবুজ। আবার ১০০০ টাকার নোটের পেছনে বাঁ দিকে হালকা নীলচে রঙের ইংরেজি অক্ষরে নিচ থেকে ওপরের দিকে লেখা আছে ‘ইঅঘএখঅউঊঝঐ ইঅঘক’লেখাটি। নোটটি এদিক-ওদিক করে নেড়েচেড়ে দেখলে চোখে পড়বে তা।

স্পার্ক বা ঠিকরে পড়া আলো: ২০০ টাকার নোটে ওপরে ডান কোনায় সোনালি থেকে সবুজ রং ছড়ানো চৌম্বকীয় কালি ব্যবহার করা হয়। ফলে এদিক-ওদিক কাত করলে এটি জ্বলজ্বল করতে থাকে। একই সঙ্গে একটি উজ্জ্বল আলোর রেখা ওপর-নিচে ওঠানামা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারেন্সি ব্যবস্থাপনা বিভাগে এক কর্মকর্তা বলেছেন, জাল নোটের সমস্যা বাংলাদেশে এখনো প্রকট সমস্যা হয়ে ওঠেনি, তবে দুই ঈদের আগে জাল নোট চক্রের তৎপরতা বাড়ে। বিশেষ করে বড় নোটগুলো যেমন ৫০০ এবং ১০০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট চালানোর চেষ্টা করা হয়। তিনি জানান, জাল নোটের তৎপরতা ঠেকানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি সরকারের কাছে নতুন একটি কঠোরতর আইনের প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে জাল নোট অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।