২৪ দিনে বিএসএফ ঠেলে দিয়েছে ১ হাজার ২০১ জন
ফেনীতে লাইট বন্ধ করে ড্রেন নির্মাণের চেষ্টা
বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পুশ ইন থামছেই না। প্রতিদিনই দেশের কোনো সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন করা হচ্ছে। পুশ ইন করা ব্যক্তিরা শুধু বাংলাদেশী নাগরিক এমন নয়-এর মধ্যে রোহিঙ্গা এবং ভারতীয় নাগরিকও রয়েছেন। পুশ ইনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে বিএসএফ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চার দফা কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানালেও ভারত সরকার সেটা আমলে নেয়নি। এটা দুই দেশের সীমান্ত প্রটোকল ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, পুশ ইনে ব্যর্থ হয়ে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, ড্রোন উড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, সীমান্ত এলাকায় গোপনে লাইট বন্ধ করে ড্রেন নির্মাণের চেষ্টাও করেছে বিএসএফ। ভারতের এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দেশের প্রতিটি সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মাঝে মধ্যে বিজিবির তৎপরতায় কয়েকটি সীমান্ত থেকে বিএসএফ পুশ ইনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেও তাদের অপকৌশল অব্যাহত রয়েছে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশের ১৬টি সীমান্ত দিয়ে ১ হাজার ২০১ জনকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ। সর্বশেষ গত ২৪ ঘন্টায় ৯৫ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে। এরআগে ১১০৬ জনকে পুশ ইন করা হয়। এরমধ্যে গত ৭ মে থেকে খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১৩২ জন, সিলেট সীমান্ত দিয়ে ১১৫ জন মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে ৩৬৯ জন, হবিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ৪১ জন, সুনামগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ১৬ জন, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ১৩ জন, ফেনী সীমান্ত দিয়ে ৫২ জন, কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ৯৩ জন, লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে ৮৫ জন, ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে ১৯ জন, পঞ্চগড় সীমান্ত দিয়ে ৩২ জন, দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে ১৫ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ১৭ জন, চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ১৯ জন, মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ৩০ জন, ঝিনাইদহ সীমান্ত দিয়ে ৫২ জন এবং সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ২৩ সর্বমোট ১১২৩ জনকে পুশইন করেছে ভারত। এছাড়া সুন্দরবনের গহীন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ৭৮ জনকে পুশইন করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মৌলভীবাজার সীমান্তে ২৯ জন, ঝিনাইদহ সীমান্তে ১০ জন, খাগড়াছড়ি সীমান্তে ১৪ জন, হবিগঞ্জ সীমান্তে ২২ জন, ফেনী সীমান্তে ১৩ ও লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে ৭ জনকে পুশ ইন করা হয়।
এরআগে একাধিকবার যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইন করায় বিএসএফের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। এছাড়া পুশইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কূটনৈতিক চ্যানেল ছাড়াও পুশ ইন নিয়ে বিজিবিও প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিজিবি জানিয়েছে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশ ইন করায় বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশে পুশ ইন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ইউএনএইচসিআরের কার্ডধারী কিছু রোহিঙ্গাও রয়েছে। আবার যারা ভারতীয় রোহিঙ্গা, তাদেরও পুশ ইন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পুশ ইন করা ব্যক্তিদের সাথে অমানবিক আচারণও করছে বিএসএফ। গত ২২ মে ভারতের হরিয়ানার বাসিন্দা পাঁচ বাংলাদেশী নারী-শিশুকে ফেনী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এর আগে ৭ মে ভারতের ইউএনএইচসিআর-নিবন্ধিত পাঁচ রোহিঙ্গাকে কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এসব ঘটনায় তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। অনেকে শারীরিক নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন। বিজিবি প্রতিটি ঘটনার তথ্য, ছবি ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে যথাযথ চ্যানেলে ভারতকে জানিয়েছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা ৭৮ জনকে রেখে গেছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। ১০ মে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা ৭৮ জনকে রেখে যায়। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে ১১টার দিকে নিজেদের একাধিক নৌযানে সীমান্তবর্তী রায়মঙ্গল নদীর পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। পরে তারা ৭৮ জনকে মান্দারবাড়ির সংলগ্ন বনের মধ্যে ফেলে রেখে যায়। পুশ ইন হওয়া ব্যক্তিরা জানায়, ভারতীয় পুলিশ তাদের বস্তিগুলোতে হানা দেয় এবং বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এছাড়াও তাদেরকে পরিবারের সদস্যদের সামনে অমানবিক নির্যাতন করার পাশাপশি পরিবারের অন্যন্যা সদস্যদেরও পাশবিক নির্যাতন করে। তারপর তাদের চোখ বেঁধে একটি সামরিক বিমানে এবং পরিবারের অন্যন্যা সদস্যদের অপর একটি সামরিক বিমান যোগে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় স্থানান্তর করে। পরবর্তীতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুন্দরবনের একটি জায়গায় রেখে যায় এবং জাহাজে অবস্থাকালীন সময়ে শারীরিক নির্যাতন, অমানবিক আচরণ, ধর্মীয় অবমাননাসূচক মন্তব্য করে। এসময় তারা প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করেনি এবং এখন পর্যন্ত তাদের স্ত্রী সন্তানদের সঠিক অবস্থান তারা জানে না। তিনি আরও বলেন, উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ১১ মে রাতে সাতক্ষীরা শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করা হয়। ভারতীয় বিএসএফ ও নৌবাহিনী কর্তৃক পুশইনকৃত ৭৮ বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে ৬৭ জনের বাড়ি নড়াইল জেলার বিভিন্ন গ্রামে।
কূটনীতিকদের মতে, বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির নতুন কৌশল হিসেবে ‘পুশ ইন’ শুরু করা হয়েছে। পুশ ইন ইস্যুতে ৮, ১৩, ১৫ ও ২০ মে ভারতকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চিঠিতে পুশ ইনের পদক্ষেপগুলো গভীর উদ্বেগের, যা চূড়ান্তভাবে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে এবং জনমনে নেতিবাচক মনোভাবও তৈরি করছে। পুশ ইন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে সীমান্ত পর্যায়ে সমন্বয় জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ভারত যেভাবে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মানুষ ঠেলে (পুশ ইন) দিচ্ছে, তা আইনসিদ্ধ নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তবে সীমান্তে পুশ ইন বাড়লেও নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সীমান্তে পুশ ইন বেড়েছে। এ জন্য আমরা প্রতিবাদও করেছি। যারা আমাদের দেশের নাগরিক, আমাদেরই ভাই-তাদের ক্ষেত্রে আমরা ভারতকে বলেছি, তোমরা প্রোপার চ্যানেলে পাঠাও। যদি আমাদের দেশের নাগরিক হয়, অবশ্যই আমরা তাদের অ্যাকসেপ্ট (গ্রহণ) করব। কিন্তু সেটা করছে না। জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আরও বলেন, ‘সীমান্তে নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই। আমার জনগণ সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ। আমার বাহিনী যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছে। কোনো রকমের অশান্তি বর্ডারে হবে না।
বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, পতাকা বৈঠক ও কূটনৈতিক চ্যানেলে বারবার প্রতিবাদ জানানোর পরও বিএসএফ ও ভারতীয় অন্যান্য সংস্থাগুলো এ ধরনের পুশ ইন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে এবং স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার করেছে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনার কথা স্বীকার করছে না, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মিথ্যাচারের শামিল। তিনি আরও বলেন, যাদের পুশ ইন করা হচ্ছে, তাদের অনেকে বাংলাদেশি হলেও বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন। তাদের সন্তানদের অনেকের ভারতেই জন্ম এবং তাদের ভারতের কাগজপত্র ছিল। জোরপূর্বক কাগজপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বারবার বলেছি, এ ধরনের একতরফা পদক্ষেপ স্বীকৃত প্রত্যাবাসন ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেই হবে।
লাইট বন্ধ করে ড্রেন নির্মাণের চেষ্টা : এদিকে ভারতের ত্রিপুরার বিলোনীয়া শহরের জমে থাকা বৃষ্টির পানি সরানোর জন্য ফেনীর সীমান্তবর্তী বল্লামুখা এলাকার নোম্যান্সল্যান্ডে ড্রেন নির্মাণের চেষ্টা চালিয়েছে বিএসএফ সদস্যরা। তবে বিজিবির বাধার মুখে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা। বৃহস্পতিবার রাতে সীমান্তের ল্যাম্পপোস্টের আলো বন্ধ করে দিয়ে তারা এমন চেষ্টা চালায়। পরবর্তীতে বিজিবি ও স্থানীয়দের বাধার মুখে তারা সরে যায়। গতকাল শুক্রবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফেনী-৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন। পরশুরামের সীমান্তবর্তী স্থানীয়রা জানান, ওপারে বিলোনীয়া শহর ও পুলিশ স্টেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে তাদের এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সেজন্য তারা পানি বের করার উপায় খুঁজছে। বাংলাদেশের ভাটির দিকে পানি ছেড়ে দিতে পারলে তাদের জলাবদ্ধতা দ্রুত নিরসন হবে, তাই তারা এমন চেষ্টা চালিয়েছে। এ দিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, সীমান্তে লাইট বন্ধ করে দিয়ে বিএসএফের আনাগোনা, স্কেবেটর রাখা এসব কিছু সন্দেহ তৈরি করছে। বল্লামুখা বাঁধে যাতে বিএসএফ হাত দিতে না পারে সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরাও চাই ভারতীয়রা জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত না থাকুক। ভাটির দিকে পানি দিবে, তবে সেটি আমাদের ক্ষতি করে নয়। ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা সতর্ক রয়েছি। তবে বাসিন্দাদের অনুরোধ, ভয় বা আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকতে হবে। এ বিষয়ে লে. কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, বিএসএফ বৃষ্টির পানি সরানোর জন্য ড্রেন নির্মাণ করছিল। কিন্তু কাজের কিছু অংশ নোম্যান্সল্যান্ডের (শূন্যরেখা) ২০ গজ এলাকার মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় আমরা বাধা দিয়েছি। কারণ শূন্যরেখার ১৫০ গজের মধ্যে কাজ করতে হলে দুদেশের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করতে হবে।