তড়িঘড়ি করে বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তাবায়নের অংশ হিসেবে চালু হওয়া মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় কমিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই প্রথম বারের মতো এ প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭৫৪ কোটি টাকা কমিয়েছে সরকার। অনুমোদনের এক দশকেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো খরচ কমছে মেট্রোরেল প্রকল্প-৬। প্রকল্পটি তৃতীয় সংশোধন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সময়সীমা বাড়িয়েছে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

মেট্রোরেলের ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটারের মতিঝিল-কমলাপুর অংশ সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) এমডি ফারুক আহমেদ বলেন, প্রকল্পটি চালুর আগে নুন্যতম ৬ থেকে ৯ মাসের পরীক্ষামূলক চলাচল নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। চার বছর আগে তাড়াহুড়ো করে ঢাকার মেট্রোরেল চালু করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, মেট্রোরেল চালুর আগে নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) ছাড়াই যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারী মারা গেছেন। এবার নতুন করে নিরাপত্তার নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএমটিসিএল।

ফারুক আহমেদ বলেন বলেন, ‘মেট্রোরেলের আগে সেফটি অডিট হয়নি। তাই সেফটি অডিট করতে চাইছি। যত দ্রুত করা যায়, সেটা আমরা করব। থার্ড পার্টিকে (তৃতীয় পক্ষ) দিয়ে এই অডিট করানো হবে। ইউরোপীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েই করানো হবে। আমাদের কাছে ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। সেফটি অডিট করার জন্য আমরা খুব শিগগির টেন্ডারের প্রক্রিয়ায় যাব।’

সূত্র জানায়, এমআরটি লাইন- ৬ দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প। এর ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশটি ইতোমধ্যেই চালু রয়েছেলাইনটি ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্বোধন করা হয়, তখন এটি উত্তরার থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচল করত। পরে ২০২৩ সালের শেষে মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশন যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি গতকাল সংশোধিত প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে। এখন এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আসন্ন বৈঠকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাছে পাঠানো হবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশন ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)–এর তথ্যানুযায়ী, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশের নির্মাণকাজ আগামী ১৮ মাসের মধ্যে শেষ হবে। এই অংশে ট্রেন চলাচল শুরু হবে ২০২৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। এর পরবর্তী ১৮ মাস ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিজনিত দায়ভারের সময় (ডিফেক্ট লাইয়াবিলিটি পিরিয়ড) হিসেবে গণ্য হবে।

প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী, এমআরটি-৬ প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১,৯৮৫.০৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৬,৫৯৪.৫৯ কোটি টাকা ছিল জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ। প্রকল্পটির প্রাথমিক বাস্তবায়ন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত।

২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পের প্রথম সংশোধন অনুমোদিত হয়, তবে তাতে ব্যয় পরিবর্তন করা হয়নি। পরে প্রকল্পটি আরও ১.১৬ কিলোমিটার বাড়িয়ে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়, এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩,৪৭১.৯৯ কোটি টাকা এবং সময়সীমা বাড়ানো হয় ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই দ্বিতীয় সংশোধন ২০২২ সালের ১৯ জুলাই অনুমোদন দেয় একনেক।

তৃতীয় প্রস্তাবিত সংশোধনে, আগের তুলনায় ব্যয় ৭৫৪ কোটি টাকা বা ২.৯৫ শতাংশ কমিয়ে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২,৭১৭.৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২,৫২১.৯৬ কোটি টাকা আসবে সরকারি অর্থায়ন থেকে এবং ২০,১৯৫.৭৬ কোটি টাকা জাইকার ঋণ হিসেবে।

সূত্র জানায়, সর্বশেষ সংশোধনে প্রকল্পের বেশ কয়েকটি খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় কমেছে ১,২১১.৭২ কোটি টাকা, কারণ বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মতিঝিল স্টেশনের প্রবেশ ও প্রস্থান কাঠামোর জন্য অতিরিক্ত ৩.৫৬ হেক্টর জমি আর প্রয়োজন হয়নি।

উত্তরা উত্তর, উত্তরা মধ্য, আগারগাঁও ও মতিঝিল স্টেশনে প্রস্তাবিত স্টেশন প্লাজা নির্মাণ বাতিল করায় আরও ১৬৪ কোটি টাকা ব্যয় কমেছে।এছাড়া মূল লাইন, সিভিল ও স্টেশন নির্মাণে ১১৬ কোটি টাকা, ইলেকট্রিক ও মেকানিক্যাল (ইঅ্যান্ডএম) রেলওয়ে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ৯০.৪৫ কোটি টাকা, এবং পুনর্বাসন পরামর্শ সেবায় ২.৯৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

এদিকে, প্রকল্পের সময়সীমা বাড়ানো এবং নকশা সংশোধনের কারণে কয়েকটি খাতে ব্যয় বেড়েছে। বেতন, ভাতা ও অফিস ভাড়ায় ব্যয় বেড়েছে ১৬৭ কোটি টাকা, আর সাধারণ পরামর্শ সেবা (জেনারেল কনসালটেন্সি সার্ভিস) ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন খাতে বেড়েছে আরও ২২২.২৫ কোটি টাকা।বিদেশি ঋণ পরিশোধÍযার মধ্যে মূলধন ও নির্মাণকালীন সুদ অন্তর্ভুক্তÍবেড়েছে ২৭০ কোটি টাকা। রোলিং স্টক ও সরঞ্জাম ক্রয়ে ব্যয় বেড়েছে আরও ৫৬১.১৭ কোটি টাকা। এছাড়া আরও কিছু ছোটখাটো খাতে অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হয়েছে, যা মোট প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানান, বিদেশি ঋণের চাপ এড়াতে সরকার বর্তমানে সব মেট্রো প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা করছে।

তিনি বলেন, দুইভাবে ব্যয় কমানো হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র নিশ্চিত করে এবং অপ্রয়োজনীয় উপাদান বাদ দিয়ে। যেমন–কমলাপুর থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর পর্যন্ত বিদ্যুতায়ন ও সিগন্যালিংয়ের যে খরচ, তা ঠিকাদারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তিন ধাপে ১৭০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, নকশা পরিবর্তন, ডিপোর সংখ্যা যৌক্তিকভাবে কমানো এবং স্টেশন প্লাজা–এর মতো কিছু অবকাঠামো বাতিল করার মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব হয়েছে।

সম্প্রতি দূর্ঘটানা নিয়ে ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, ‘বিয়ারিং প্যাড হঠাৎ করে পড়ে যায়নি। এটা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার জিনিস নয়। যেহেতু এটা নিয়ে তদন্ত চলছে, ফলে এ বিষয়ে আমি জাজমেন্টাল হতে চাই না। তবে যেটা হতে পারে, সেটা বলতে পারি, ডিজাইন ফল্ট হতে পারে। যে জিনিসের ওপর বসানোর কথা বলা হয়েছিল, যা যা দেওয়ার কথা ছিল, সেটা বসানো হয়নি। যে ডিজাইনে হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়তো ঠিকাদার করেনি। যে পরামর্শককে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা হয়তো ঠিক করে জিনিসটা বুঝে নেয়নি। এই চারটা কারণে হতে পারে অথবা এর মধ্যে কোনো একটা কারণেও হতে পারে।’

এসব কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য হাজার কোটি টাকায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা আছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘প্রথম ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন পরামর্শক। আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরামর্শকদের। তখন এই কাজগুলো কিছুটা তাড়াহুড়ো হয়েছে। কেন হয়েছে, সেটার উত্তর তো আমি দিতে পারব না। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অংশে অনেক ডিফেক্ট আছে। ফলে সেটা এখনো আমরা বুঝে নিইনি।’

ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, যেখানে বিয়ারিং প্যাড পড়ে গিয়েছিল, ওই অংশের ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার সময়সীমা (ডিফেক্ট লায়াবেলিটি) গত জুন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু ডিএমটিসিএল তাদের এই সময়সীমা গ্রহণ করেনি। কারণ, এখনো অনেক বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। যত সমস্যা আছে, এগুলো ঠিকাদারকে মেরামত করতে হবে। এজন্য ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি’ দুই বছর বাড়ানোর জন্য ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।

দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেলের সবকটি পিলার পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, এর আগে পুরো পথের বিয়ারিং প্যাডের ছবি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে। এরপর কর্মকর্তারা সরেজমিনে নিরীক্ষা করেছেন। যেসব স্থানে ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে। ডিএমটিসিএলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, যেখানে ত্রুটি বা সমস্যা পাওয়া যাবে, সেখানে বিয়ারিং প্যাড অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে।