গতকাল শুক্রবার সকালে বাংলাদেশে ভূমিকম্পে যে তীব্র ঝাঁকুনি হয়েছে, তাকে এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, যে অঞ্চলে ভূমিকম্পটি হয়েছে, সেটি ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের অংশভুক্ত। ভূমিকম্পটিতে যে তীব্র, যে প্রচ- ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে, তা তার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের পটভূমিতে এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, এর আগে ২০০৩ সালে রাঙ্গামাটিতে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি বরকল ইউনিয়নে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এটিও অনেক শক্তিশালী ছিল। তবে ১৯১৮ সালে দেশের অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।

সূত্র মতে, পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছরই মানুষের জীবন, সম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ভৌগোলিক অবস্থান এসব দুর্যোগের অন্যতম কারণ। নতুন করে এ খাতায় নাম লিখিয়েছে ভূমিকম্প। সাম্প্রতিক সময়ে হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূকম্পন অনুভূত হলেও একসময় এ অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। যা মোকাবেলায় সরকারের ন্যূনতম কোনো প্রস্তুতিও নেই।

এত বড় ঝাঁকুনি ও শক্তিশালী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেন, দেশের পূর্ব প্রান্তটা হচ্ছে বার্মা প্লেট, পশ্চিমটা হচ্ছে ইন্ডিয়ান প্লেট, এই সংযোগস্থলে ভূমিকম্প হয়েছে। এবং এই সংযোগটা এতদিন আটকে ছিল। এখন এই সংযোগটা আজকে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে খুলে গেছে। অর্থাৎ আটকানোটা বা লকটা খুলে গেছে। এখন সামনে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। শুক্রবারের এই ভূমিকম্প সেই সতর্কবাণী দিচ্ছে। প্লেট যেটা আটকে ছিল, সেটা আটকানো অবস্থা থেকে খুলে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে আরও বড় ভূমিকম্প হবে। যেটা আমরা ২০১৬ সাল থেকে বলে আসছি।

সূত্র মতে, চলতি বছরে গতকাল পর্যন্ত ১০টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে দেশে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে এ বছর প্রথম ভূকম্পন অনুভূত হয় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। ৩ দশমিক ৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পে জানমালের তেমন ক্ষতি হয়নি। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে মাঝারি মাত্রার জোড়া ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। চট্টগ্রামে গত ৩০ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। গত ৫ মে রাজধানীতে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। গত ৫ জুন ৩.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে। ১৬ জুন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ১৪ আগস্ট সিলেটে ফের ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। একই সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলায়ও এটি অনুভূত হয়। ঠিক ১৬ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৯ আগস্ট সিলেট মহানগরীর আশপাশে ফের ৩ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়। ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটে ৪ দশমিক ৪ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

বড় ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প গবেষক মেহেদি আহমেদ আনসারী। তিনি বলেন, বড় ভূমিকম্প আসার আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। এটি তার আগাম বার্তা। তিনি বলেন, সাধারণত একশ থেকে দেড়শ বছর পরপর একটি অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ও এর আশপাশের কাছাকাছি এলাকায় গত দেড়শ বছরে একটি বড় ও প্রায় পাঁচটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আশপাশে সবশেষ বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছিল প্রায় একশ বছর আগে। তাই আরেকটি বড় ভূমিকম্প কাছাকাছি সময়ে হতে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে। সচেতনার বিষয়ে তুলে ধরে বলেছেন, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি করলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, এটিই স্বাভাবিক। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে যে ভবনগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে, তাতে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির বলেন, ঢাকা এবং এর আশপাশে বিগত কয়েক দশকে সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প। এই সময়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ৪ থেকে ৫ মাত্রার সামান্য বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের বাইরে। তিনি আরও জানান, ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে একাধিক বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, এটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। যে কোনো সময় বাংলাদেশে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ঠিক কবে হবে সেটা আমরা বলতে পারি না।

দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসাইন ভূইয়া। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান এমন যে, ভূমিকম্প হওয়া অবশ্যম্ভাবী। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান তিনটি টেকটোনিক প্লেটÍইন্ডিয়ান প্লেট, বার্মিজ প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি সবসময় বিদ্যমান। বাংলাদেশের ভূগঠন মূলত নরম শিলা দিয়ে তৈরি। তাই নি¤œ ফ্রিকোয়েন্সি ও উচ্চ অ্যাম্পলিচিউডের ভূমিকম্প হলে ক্ষতি বেশি হয়। ভূমিকম্পের কম্পন মাটির নিজস্ব কম্পাঙ্ক ও ভবনের কম্পাঙ্ক একসাথে মিলে গেলে তা আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া, কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায়, এলাকাটি হচ্ছে দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল। এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত বার্মা প্লেট, পশ্চিমে অবস্থিত ইন্ডিয়ান প্লেট। এর সংযোগস্থলের উপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি ‘লকড’ হয়ে আছে। অর্থাৎ এখানে শক্তি জমা হয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। যেকোনো সময় এ শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের আশপাশ দিয়ে তিনটি টেকটোনিক প্লেট গেছে। এগুলোর সংযোগস্থল আমাদের সীমান্তের আশেপাশে। যেমন- আমাদের উত্তরে হিমালয় পড়েছে ইউরেশিয়ান প্লেটে। আমাদের অবস্থান ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটে। আর আমাদের পূর্বে হচ্ছে বার্মার মাইক্রো প্লেট। এ তিনটি প্লেটই আমাদের কানেক্টেড এবং সক্রিয়। প্লেটগুলোর মুভমেন্ট আছে। এগুলো প্রতি বছরে পাঁচ সেন্টিমিটার বা ৫০ মিলিমিটার মুভমেন্ট করে। তার মানে, প্রতি বছর আমরা পাঁচ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুভমেন্ট করছি। একইভাবে পুরো পৃথিবীও মুভ করছে। বলা যায়, পুরো পৃথিবীই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর মুভমেন্ট তিনটি ক্রাইটেরিয়ায় সম্পন্ন হচ্ছে। প্রথমটি হলো- কনভারজেন্ট মুভমেন্ট, অর্থাৎ দুটি প্লেট একই দিকে পরিচালিত হয়ে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হলো, একটি প্লেট একদিকে এবং অপরটি বিপরীত দিকে মুভ করছে। এটিকে বলে ডাইভারজেন্ট মুভমেন্ট। তৃতীয়টি হলো- ল্যাটেরাল মুভমেন্ট, অর্থাৎ যদি কোনো একটি প্লেট স্টাবল থাকে এবং অপরটি মুভ করে। এ তিন ক্রাইটেরিয়ায় পৃথিবী মুভ করছে। এ আবহাওয়াবিদ বলেন, নেপালে যেমন ইউরেশিয়ান প্লেট আর আমাদের ইন্ডিয়ান প্লেট (বাংলাদেশ যে প্লেটে অবস্থান করছে)। দুটি প্লেটের কনভারজেন্ট মুভমেন্ট বিদ্যমান। কনভারজেন্ট মুভমেন্ট হওয়ায় একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের দিকে মুভ করছে এবং একটি প্লেট গ্রাজুয়ালি রাইজিং করছে। অর্থাৎ হিমালয়ের যে উচ্চতা, যেটি গত বছর যা ছিল তার চেয়ে একটু হলেও বেড়েছে। এজন্য যখন প্লেট মুভ করে এবং কোনো কারণে যদি ওখানে মুভমেন্ট কম হয় বা মুভমেন্ট না হয় তখনই সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। দেখা যায়, আমাদের প্লেট বাউন্ডারির লাইনগুলোতে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সংঘর্ষের ফলে যদি এনার্জি রিলিজ হয়, তাহলে ভালো। আর যদি এনার্জি রিলিজ না হয়, যদি সেখানে প্লেট বাউন্ডারি থাকে তাহলে এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, পরে যখন সেখান থেকে বড় ধরনের এনার্জি রিলিজ হয় তখন ভূমিকম্পের মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশের আশপাশে সক্রিয় তিনটি প্লেটের কারণে প্রবল ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দেশ, এটি নিশ্চিত।

অতীতের ঘটনা থেকে বলা যায়, যেখানে প্লেট বাউন্ডারি লাইন থাকবে অর্থাৎ দুটি প্লেটের সংযোগস্থল থাকবে, তার আশেপাশে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি। যেহেতু বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির খুবই কাছাকাছি (বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ১০০ বা ১২০ কিলোমিটারের মধ্যে প্লেট বাউন্ডারি অবস্থিত), সুতরাং বাংলাদেশ অবশ্যই ঝুঁকির মধ্যে আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভূমিকম্পের সোর্স হচ্ছে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণে আনা। এটি খুবই কঠিন কাজ। পর্যবেক্ষণের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো দেখভাল করছে। তারা ১০০ মিটারেরও বেশি গভীরে যন্ত্র স্থাপন করেছে এবং যখনই ভূকম্পনের তথ্য পাচ্ছে তখনই তারা অ্যালার্ম দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্লেটগুলোর এনার্জি স্টোর থেকে যখনই এনার্জিটা আউটবার্স্ট হচ্ছে তখনই ভাইব্রেশনটা শুরু হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো এক দিন বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পেরও আগাম বার্তা দিতে পারবে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সাবডাকশন জোন এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। সেই ভূমিকম্পগুলো ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, নদী-নালার গতিপথের পরিবর্তন এনেছে। ১৭৬২ সালের আসাম ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদীর দিয়ে চলে যায়। আগে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়েই এ নদের বেশির ভাগ পানি প্রবাহিত হতো। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বড় বড় ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠকে কোথাও উঁচু করে দেয়, আবার কোথাও নিচু করে দেয়। যেমন- চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সৃষ্ট হয়েছে ভূমিকম্পের মাধ্যমে। এ ছাড়া জনবসতিও স্থানান্তর করে ভূমিকম্প। জানা যায়, ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। ১৮৯৭ সালে গ্রেট ইন্ডিয়া ভূমিকম্পে এক হাজার ৬২৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া, ১৭৬২ সালের ভূমিকম্প হয়েছিল সাবডাকশন জোনে। ৮০০ থেকে এক হাজার বছর আগে কুমিল্লার ময়নামতিতে ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্লেটগুলো জমাটবাঁধা শক্তি বের করেছিল। এরপরই নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে এ অবস্থায় এসেছে। তার মানে, গত এক হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হতে হতে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়েছে। এ শক্তিই যেকোনো সময় বের হয়ে আসতে পারে। ১৭৬২ সালের আগে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ডের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এটি ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। ভাটার সময় কিছুটা জেগে উঠত এবং জোয়ারে ডুবে যেত। একটি ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার ওপরে উঠে আসে। ওই একই ভূমিকম্পে সীতাকু-ের পাহাড়ে কাদা-বালির উৎগীরণ হয়।

কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে বাংলাদেশের কিছু গবেষক। এই গবেষণার মাধ্যমে ১৪ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্লেটের গতির পরিমাপ নির্ণয় করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, প্রতিটি প্লেট এক স্থান থেকে আরেক স্থানে প্রতি বছর সরে যাচ্ছে। প্লেটগুলো কোন দিকে যাচ্ছে, দুটি প্লেটের সংযোগ বা পরস্পরমুখী যে গতি এবং সাবডাকশন জোনে প্রতি বছর কী পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, সেটিও গবেষণার ুএঠ আসে। ২০১৬ সালে গবেষণা থেকে দেয়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। যেকোনো সময় এ শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। এ শক্তি একবারে বের হতে পারে আবার ধীরে ধীরেও বের হতে পারে

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকায় এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকে ভূমিকম্পের উৎস ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে হলেও ঢাকাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি জনগণের বাস। এখানে অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এবং ভূমিকম্পের বিষয়ে মানুষদের মধ্যে চরম সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ শহরের মানুষ জানে না ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে বা আগে কী কী প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। তারা এটিও জানে না যে ভূমিকম্পের সময় মানুষ কীভাবে নিরাপদে অবস্থান করবে। সরকারেরও এ বিষয়ে প্রস্তুতির অভাব রয়েছে।

জানা গেছে, ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর বিষয়ে সরকার ২০০৮ সালে সিবিএমপি’র মাধ্যমে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। কিন্তু সেটি যথেষ্ট নয় বা তার ধারাবাহিকতা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজটি করতে হবে। যদি ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ঢাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে পারে। যেহেতু সেভাবে কোনো পরিকল্পনা নাই সেহেতু ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। এজন্য পরিকল্পনা করে ঢাকার ওপর চাপ কমিয়ে দেশের জনবসতি পশ্চিমাঞ্চলের দিকে নিয়ে যাবার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

রাজউক ও সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ঢাকা শহরে ২১ লাখের বেশি ভবন আছে। এর মধ্যে ছয় লাখ ভবন ছয়তলার ওপরে। বাকিগুলো ছয়তলার নিচে। বড় ভূমিকম্প হলে এই ছয় লাখ ভবন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। একটি বড় ভবন ধসে পড়লে কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা বোঝাতে গিয়ে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেন বিশেষজ্ঞরা। সেজন্য সরকারকে এখনই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার ভবনগুলো ভূমিকম্প মোকাবেলায় সক্ষম কিনা তা পরীক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। কারণ রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রায় যে ক্ষতি হয়েছে, ৭ মাত্রার হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে, ভেঙে যাবে ভবন, হতাহত হবে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন ভূমিকম্প হলে ২-৩ লাখ মানুষ হতাহত হবে, ঢাকা শহরের ৩৫% ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে, অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

ভূমিকম্পের ঘটনায় সতর্ক হতে বলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে এত জোরে, এত শক্তিশালী ভূমিকম্প আমরা অনুভব করিনি। তিনি বলেন, এটা আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। এটাকে আমলে নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। অগ্নি ঝুঁকি, ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবেলায় তিন বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আগানো উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ এখনো একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত নয়। যদিও ভূমিকম্পের ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে। সম্প্রতি মিয়ানমার ও নেপালে পরপর কয়েকটি ভূমিকম্প এই অঞ্চলের জন্য এক ভয়াবহ সতর্ক বার্তা হয়ে এসেছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম (রিজু) বলেন, আমরা ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বাস করলেও তা নগর নকশা, ভবন নির্মাণ বা জনসচেতনতায় যথেষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে না। ভূমিকম্প প্রতিরোধে এখনই সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দরকার। ভবন নির্মাণে বিশেষ সতর্কতা ও আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে এখনই। নগর পরিকল্পনায় ভূমিকম্প প্রতিরোধে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিদ এম. আল-হুসেইনী বলেন, ঢাকার মাটি মূলত নরম ও অবিচল নয়। ভূমিকম্প হলে এমন মাটিতে নির্মিত অনেক ভবন ধসে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রায় ৭০ ভাগ ভবনের নকশায় ভূমিকম্প প্রতিরোধের বিষয়টি উপেক্ষিত। জরুরি ভিত্তিতে রেট্রোফিটিং দরকার।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির পাশাপাশি দুর্যোগকালীন রেসপন্স ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। স্কুল, কলেজ, হোস্টেল, সবখানে সিমুলেশন ও মহড়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে।