প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে সাময়িক সমাধান দিতে চায় না আপিল বিভাগ। এ নিয়ে কার্যকর সমাধান চায়, যাতে এটা বার বার বিঘিœত না হয়। এ সময় তিনি প্রশ্ন তোলেন যদি তত্ত্বাবধায়ক ফিরিয়ে দেই তবে এটি কবে থেকে কার্যকর হবে? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণ দিতে পারে।
গতকাল বুধবার দুপুরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ শুনানির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন। সেই সাথে আগামী ২১ অক্টোবর এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন।
গতকাল সকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে দ্বিতীয় দিনের রিভিউ শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে সাময়িক সমাধান দিতে চায় না আপিল বিভাগ। এ নিয়ে কার্যকর সমাধান চায়, যাতে এটা বার বার বিঘিœত না হয়। এ সময় তিনি প্রশ্ন তোলেন যদি তত্ত্বাবধায়ক ফিরিয়ে দেই তবে এটি কবে থেকে কার্যকর হবে?
অন্যদিকে শুনানিতে রায়ের পর কীভাবে কার্যকর হবে, সে বিষয়ে আপিল বিভাগ জানতে চাইলে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণ দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। সকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে রিভিউ শুনানিতে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঠলে, এর উত্তর দিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে অনুরোধ করেন প্রধান বিচারপতি।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, গেল দেড় দশকে দেশের মানুষ শাসিতের পরিবর্তে শোষিত হয়েছে নানাভাবে। মানুষ গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যা ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেসব সিস্টেম ছিল সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং মানুষ বিচার পায়নি। যার কারণে এই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। আর সেই রাজপথ থেকেই নির্ধারিত হয়েছে কে প্রধান বিচারপতি হবেন আর কে সরকার প্রধান হবেন। জনগণের এই ক্ষমতাকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এসব অবজ্ঞা করলেই বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। এ সময় ’৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন তিনি।
আদালতে বিএনপি’র আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস (কাজল)। জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শরীফ ভূইয়া এবং অপর আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এ এস এম শাহরিয়ার কবির।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালে। এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন।
পরবর্তীতে ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ঘোষিত রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপসহ বেশকিছু বিষয়ে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়।
এদিকে গত ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
শুনানীর পর ব্রিফিংকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় লেখা থেকে শুরু করে স্বাক্ষর করা পর্যন্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এর জন্য খায়রুল হকের ৭ বছর সাজা হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই রায় লেখা থেকে শুরু করে স্বাক্ষর করা পর্যন্ত আইনি পরিক্রমায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যে অপরাধ করেছেন, সে অপরাধ দ-বিধির ২১৯ ধারায় একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ। এর জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছরের সাজা হতে পারে।
তিনি বলেন, উনি (খায়রুল হক) জানতেন একটা জাজমেন্ট প্রনাউন্সম্যান্টের পর সেই জাজমেন্ট একমাত্র রিভিউ ফোরামে পরিবর্তন করা যাবে। এরপরও ক্ষমতা না থাকলেও রায় বদলেছেন, এটা অপরাধ। আমরা এটা আদালতের নজরে আনবো।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, খায়রুল হকের দেয়া রায় বাতিল হলে দেশের গণতন্ত্র সুসংহত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হবে। আপিলে আমাদের প্রার্থনা থাকবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে যে রায় হয়েছে, সেই রায় বাতিল করে বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করে দেয়া।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্রের পথে নেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চাই। আমরা মনে করি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে। এই রায় ক্যন্সারের মতো। এই রায় বাতিল হওয়া দরকার।
তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার কারণে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা, গনতন্ত্র, ভোটাধিকার ও আইনের শাসনসহ দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আগামী ২১ অক্টোবর আপিল শুনানিতে আমাদের প্রার্থনা থাকবে, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি বাতিল করে বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করে দেওয়া।’