আজ ৩১ জুলাই বৃহস্পতিবার। ২০২৪ সালের এই দিন বুধবার ছিল। এদিন সারাদেশজুড়ে ক্র্যাকডাউন চলছিল ছাত্র-জনতার ওপর। বিশেষ করে বিরোধী মতের রাজনীতির ওপর জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীদের যেখানে পাও গ্রেফতার করার মিশনে নামে প্রশাসন। এমনকি সাধারণ মানুষকেও জামায়াত শিবিরের ট্যাগ দিয়ে গ্রেফতারের মহোৎসব শুরু করে স্বৈরাচার হাসিনার অনুগত কর্মকর্তারা। আগের দিন শোকের কালোর বদল দ্রোহ আর বিপ্লবের রং লাল ধারণ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সরকারের নীতি নির্ধারকরা। তারা যেকোন মূল্যে ছাত্রদের দমনের পাশাপাশি সন্দেহের তালিকায় থাকা জামায়াত শিবিরকে দমনের এবং শায়েস্তা করার উদ্যোগ নেয়।

৩১ জুলাই বুধবার দুপুরে সারাদেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। অনলাইনে বার্তা আদান প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে আগের রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের রাত সোয়া ১১টার দিকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির ঘোষণায় বলা হয়, ‘সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা, গুম-খুনের প্রতিবাদে ও জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হবে।’ ঘোষণায় আরও বলা হয়, ‘আমরা সারাদেশের শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সব নাগরিককে আমাদের কর্মসূচি পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাদের দাবি আদায়ের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ছাত্রদের ডাকে সাড়া দিয়ে বুধবার সারাদেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়। এর অংশ হিসেবে সেদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন জায়গায় লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।

মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুর ১২টা থেকে হাইকোর্টের মাজার গেট এলাকায় জড়ো হন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। পরে প্রায় তিন ঘণ্টা শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান নিয়ে সরকার বিরোধী নানা স্লোগান দেয় ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের এসব স্লোগান ভাইরাল হয়। কতিপয় পুলিশ শিক্ষার্থীদের মুখ চেপে ধরে। এসব ভিডিও ভাইরাল হলে ক্ষোভ ছড়িয়ে পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে। শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয় কে এসেছে ? কে এসেছে ? পুলিশ এসেছে। কি করেছে? কি করেছে ? স্বৈরাচারের পা চেটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা শিক্ষার্থীদের মুখ চেপে ধরার প্রতিবাদ করেন। পুলিশ সেদিন শিক্ষার্থীদের দেশটাকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র করছে বলে প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করেন।

হাইকোর্টের ভেতরে আইনজীবীদের একটি দল সেদিন মিছিল করেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ বেলা একটার দিকে মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের দিকে যেতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। একপর্যায়ে তারা দোয়েল চত্বরে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পরে সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশ করেন। বেলা তিনটার দিকে সেখান থেকে তারা চলে যান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকেরাও অংশ নেন। বেলা একটার দিকে কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনসংলগ্ন মহুয়া মঞ্চের সামনে জড়ো হন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে তারা সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের ১০-১৫ জন শিক্ষক যোগ দেন। মিছিলটি শহীদ মিনারসংলগ্ন সড়ক, নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনের সড়ক প্রদক্ষিণ করে একইস্থানে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করেন তারা। কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী ও বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীম হোসেন।

সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা বাধা পেরিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এতে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন বলে দাবি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ফয়সাল হোসেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টার দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকেন। পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন। এ সময় সেখানে পুলিশ অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের সরে যেতে বলে। তবে শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টার দিকে সিলেট শহরের দিকে পদযাত্রা নিয়ে যেতে থাকেন। সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা নগরের সুবিদবাজার মোড়ে পৌঁছালে সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা তাদের পথ রোধ করেন। শিক্ষার্থীরাও সুবিদবাজার মোড়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বাগবিত-া ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনে যেতে থাকেন। পুলিশ সদস্যরা সড়কের পাশে অবস্থান নিয়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। শিক্ষার্থীরাও ইটপাটকেল ছোড়েন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

খুলনায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পাল্টায় শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল ছোড়েন। আজ বুধবার বেলা দুইটার দিকে নগরের রয়েল মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় সাতরাস্তা মোড়, রয়েল মোড়সহ পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আজ শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও রাস্তা অবরোধ করে মানুষের জানমালের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবিরের লোকজন বেশি ছিল বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বরিশালে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। এতে ৪ সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করে পুলিশ।কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া একাধিক ব্যক্তি জানান, বেলা ১১টার পর নগরের সদর রোডসংলগ্ন কাঠপট্টি সড়কের মুখে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রতিবাদ মিছিল করার চেষ্টা করলে পুলিশ প্রথমে বাধা দেয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকজন অভিভাবককেও এ কর্মসূচিতে একাত্ম হতে দেখা যায়। একপর্যায়ে বাধার মুখে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। পরে সিটি কলেজের গলির মুখে শিক্ষার্থীদের আটকে দেওয়া হয়। আরও শিক্ষার্থী এক জোট হয়ে সদর রোডে অবস্থান নিলে ধাওয়া দিয়ে তাদের ফকিরবাড়ি রোডে আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। ঘটনার সময় উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় তাদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে চার সাংবাদিকসহ ছয়জন আহত হন। এর প্রতিবাদে তারা সদর রোড আটকে সড়কে বসে পড়েন। আন্দোলনকারীরা জানান, শিক্ষার্থীরা সদর রোড ত্যাগ করে ফজলুল হক অ্যাভিনিউয়ে বরিশাল জেলা জজ আদালতের সামনে অবস্থান নিলে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে আবারও লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। এ সময় অন্তত চারজন আহত হন। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামেও বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের বাধা ভেঙে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আদালত চত্বরে প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। দুপুর ১২টার দিকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা আদালত চত্বরে অবস্থান করছিলেন। এ সময় এনেক্স ভবনের সামনে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা বিক্ষোভকারীদের বাধা দেন। তখন মৃদু ধাক্কাধাক্কি হয়। তবে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। এর আ গে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালত ভবনের জহুর হকার্স মার্কেট–সংলগ্ন ফটকের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। এ সময় ফটকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। শিক্ষার্থীরা আদালত ভবনের ফটকের পাশে জেলা পরিষদ চত্বরে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় ওই এলাকায় রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

রাজশাহীতে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি পালন করতে শিক্ষার্থীরা আদালতের সামনে সমাবেশ করবেন খবর পেয়ে আজ সকাল থেকেই ওই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যরাও ছিলেন। বিকেল চারটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সেখানে সমাবেশ করতে যাননি। শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করতে না পারলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল ও প্রতিবাদী সমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের ৯ দফা মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

এদিন সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময়ের জন্য ডেকে কথা বলতে না দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় সাবেক ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ ‘ভুয়া ভুয়া’ বলেও স্লোগান দেন।

এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। বেলা ১১টায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকেও আগের দিন জানানো হয়। অন্যদিকে ছাত্রনেতারা জানান, তাদেরকেও মতবিনিময় সভার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ছাত্রলীগের কয়েক শ সাবেক নেতা দলীয় কার্যালয়ের দোতলার সম্মেলনকক্ষে উপস্থিত হন। এর মধ্যে সংসদ সদস্য, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতারা ছিলেন। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা মতবিনিময় না করেই গণমাধ্যমের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে শুরু করেন ওবায়দুল কাদের। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। পরে যা হট্টগোলে রূপ নেয়। কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন, ‘মতবিনিময় সভা ডেকে সংবাদ সম্মেলন করছেন কেন? তাহলে আমাদের ডাকলেন কেন? আগে আমাদের কথা শুনবেন, আলোচনা করবেন, তারপর ব্রিফ করেন। তা না করে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলা শুরু করে দিলেন...।

একাধিক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তারা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে ওবায়দুল কাদের নিজে বক্তৃতা করে চলে যাবেন। বৈঠকে এসে তাই দেখতে পান। এতে নেতারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সাবেক ছাত্রনেতারা বলেন, হট্টগোল শুরু হলে প্রথমে ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা যায়, ‘কে, কে, থামো।’ কিন্তু এরপরও হট্টগোল চলতে থাকে। এরপর সংবাদ সম্মেলন অন্যান্য দিনের মতো দীর্ঘ না করে সভাস্থল ত্যাগ করেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় পেছনে বসা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে আওয়াজ করেন। তারপর অনেকেই ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে ওঠেন। পরে সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় না করেই আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিজের কক্ষে চলে যান ওবায়দুল কাদের। অন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও যাঁর যাঁর মতো করে চলে যান। এ সময় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের নিচতলা ও সামনের সড়কে থাকা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এ অবস্থা ঘণ্টাখানেক চলে। এদিন ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মতবিনিময় সভায় আসা ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা সাংবাদিকদের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।

এদিন রাতে ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পান অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। সেখান থেকে বের হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ছয়দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ছয়জনকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে আটকে রাখবেন ? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত, সেগুলো কীভাবে নিবৃত্ত করবেন?

এদিকে রাজসাক্ষী হওয়া পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আন্দুল্লাহ আল মামুন তার জবানবন্দীতে কতগুলো সত্যি স্বীকার করেছেন। জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক হতো তাদের। বৈঠকে দুজন সচিব, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবির হারুন অর রশীদ, র‌্যাবের মহাপরিচালক, আনসারের ডিজি, এনটিএমসির জিয়াউল আহসানসহ অনেকে উপস্থিত থাকতেন। মূলত এ বৈঠক থেকে সবরকম নির্দেশনা ও পরামর্শ করা হতো। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি আরও বলেন, কোর কমিটির এক বৈঠকে সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছয় সমন্বয়ককে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। আন্দোলন প্রত্যাহারে তাদের মানসিক নির্যাতন ও চাপ দেওয়া হয়। কর্মসূচি প্রত্যাহারে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিতে বলা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুনকে ‘জিন’ বলে ডাকতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেননা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সবচেয়ে কার্যকর মনে করা হতো তাকে। আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার থেকে গুলীর বিষয়ে জবানবন্দিতে মামুন বলেন, আন্দোলনকারীদের নজরদারি, গুলী করে ভীতিকর পরিবেশ তৈরির গোপন পরিকল্পনা হয়। র‌্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশিদের পরিকল্পনায় মূলত রাজনৈকি সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়।

আন্দোলন দমনে লেথাল উইপেন বা মারণাস্ত্র ব্যবহারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ অতিউৎসাহী ছিলেন বলেও জবানবন্দিতে জানিয়েছেন সাবেক এই আইজিপি। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার এবং আন্দোলন প্রবণ এলাকায় ব্লক রেইডের সিদ্ধান্ত হয় রাজনৈতিকভাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে তাকে লেথাল উইপেন ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়েছিলেন। ডিএমপি সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব এবং ডিবির সাবেক প্রধান হারুন লেথাল উইপন ব্যবহারে অতিউৎসাহী ছিলেন।

এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে পরামর্শ ও উসকানি দিয়েছিলেন বলেও জানান সাবেক আইজিপি। সরকার পতনের দিন তিনি কীভাবে সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটিও বলেছেন জবানবন্দিতে। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট বিকালের দিকে একটি হেলিকপ্টার আসে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে। ওই হেলিকপ্টারে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যান তিনি। এরপর সেখান থেকে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন।