সারা দেশের সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাদ ব্যবহার করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, এটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, বাস্তবায়ন করা কঠিন। ডিসেম্বরের সময়সীমা বেধে না দিয়ে সময় নিয়ে এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তাড়াহুড়ার কারণে কেনাকাটায় অনিয়ম হতে পারে, নি¤œমানের পণ্য দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের ঝুঁকি থাকে।

গতকাল রোববার রাজধানীর সিপিডি কার্যালয়ে সিপিডি ও বাংলাদেশ সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউবেল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআরইএ) যৌথভাবে আয়োজিত ‘জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি; নকশা, বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো বিষয়ে প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলে বিশিস্টজনরা । সেমিনাওে সিপিডির নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তী। আর বিএসআরইএর নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের সদস্য মো. নাসির উদ্দিন।

সেমিনাওে সিপিডির পক্ষ থেকে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ২০১০ সালে বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ–সংযোগের জন্য চাহিদার ৩ শতাংশ সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়। এতে সংযোগ পেতে নামমাত্র সৌরবিদ্যুৎ বসানো হয়েছে। এটা একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল। নি¤œমানের সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে, যা কোনো কাজে আসেনি।

সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাড়াহুড়ার ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সরকারি অফিস বেশি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ হবে কি না, গ্রিডের অবস্থা কী, এগুলো আগে থেকে চিন্তা করতে হবে। বিদ্যুতের দাম আলাদা করে নির্ধারণ করে দিতে পারে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

ছাদ বিদ্যুৎ বাস্তবায়ন নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি। এতে বলা হয়, শুরুতে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ছাদ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেখা যেতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে ৪০০ থেকে ৫০০ ভবনে করা উচিত। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগে বাছাই করা কিছু ভবনে এটা করতে হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় নিজ নিজ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে করবে। এটা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে পারে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য জানা যাবে।

ছাদ বিদ্যুৎ প্রকল্প ভালো উদ্যোগ হলেও এটিকে সতর্কভাবে স্বাগত জানিয়েছেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, এর আগে বাসাবাড়িতে লোকদেখানো সৌরবিদ্যুৎ বসানো হয়েছে। এতে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। সে জায়গায় যেন বর্তমান কর্মসূচি না যায়, তাই সতর্ক থাকতে হবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট স্থাপন করতে চায় সরকার। তারা হয়তো তাদের মেয়াদের মধ্যে এটি করে দেখাতে তাড়াহুড়া করছে। যদিও এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। দ্রুত করতে গেলে নানা সমস্যা হতে পারে। সরকারের ক্রয় প্রক্রিয়ায় ত্রুটি দেখা দিতে পারে। ক্রয় প্রক্রিয়া নয়ছয় করে কারও পকেট ভারী যেন না হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে।

বিএসআরইএ সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদ বলেন, সাহসী ও উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ। অতীতের মতো যাতে ধ্বংস না হয়, সতর্ক থাকা জরুরি। তাড়াহুড়া করে ছয় মাসের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক ভুঁইফোড় কোম্পানি কাজ নিতে পারে।

আলোচনা সভায় বিএসআরইএর পক্ষ থেকে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এতে মূলত বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে, যা কোনোভাবেই ৩ শতাংশের বেশি নয়। গ্রামাঞ্চলে স্কুল, কলেজে নিরাপত্তা থাকে না, তাই সৌর প্যানেল চুরি হতে পারে। এটি বিবেচনায় রাখতে হবে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন পণ্য আমদানি শুল্ক বেশি।

পাওয়ার গ্রিড পিএলসি বাংলাদেশের প্রধান প্রকৌশলী সরদার মোহাম্মদ জাফরুল হাসান বলেন, গ্রিড মূলত ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন। ছাদে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যাবে ৩৩ কেভি বিতরণ লাইনে। তবে সৌরবিদ্যুৎ বেশি হলে গ্রিডে সামঞ্জস্যের বিষয় আছে। ইতিমধ্যে গ্রিডে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ছাদ থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট যুক্ত হলে গ্রিডে কোনো সমস্যা হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই অর্থায়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক খোন্দকার মোর্শেদ মিল্লাত বলেন, সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রকল্প হলো ছাদে সৌরবিদ্যুৎ। ছাদে বিদ্যুৎ অর্থায়নে ব্যাংক উৎসাহ দিচ্ছে। সুদের হার ৩ শতাংশ করা যাবে না, এটা ৫ শতাংশ ঠিক আছে। ব্যাংকের আর্থিক দিকটিও বিবেচনা করতে হবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডার) পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ২০১০ সালে বাসায় সৌরবিদ্যুৎ বসানোর বাধ্যবাধকতা ছিল, উৎপাদনের বাধ্যবাধকতা ছিল না। তাই ওইটা কোনো কাজে আসেনি। ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বাধ্যবাধকতা দিয়ে দিতে হবে। উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, বাস্তবায়ন কঠিন। তবে এটি ডিসেম্বরে না হলেও আগামী জুনের মধ্যে হবে। সব একসঙ্গে হবে না। সব বিতরণ কোম্পানি কিছু উপজেলায় করবে শুরুতে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, আলোচনা সভায় যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এগুলো বিবেচনায় নিয়েই কাজ করছে সরকার। শিগগিরই পরিষ্কার নির্দেশনা সবাই পাবে। পিডিবির প্রকল্প সংস্থাটির নিজস্ব জনবল প্রশিক্ষণ দিয়ে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। ছাদে করলে জমির অপচয় হয় না, খরচও কমে যাচ্ছে।