নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে ম্যানেজমেন্টে এম এ করেছেন মাহবুব আলম। শখ করে তিন ফটোগ্রাফি করতেন। ভোর হলেই ছবি তোলার জন্য ক্যামরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। টগবগে যুবক মাহবুব আজ অন্ধ। জুলাই গনঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলীতে দুটি চোখ হারান তিনি। চিরদিনের জন্য চোখের আলো নিভে গেছে তার। বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র মাহবুবের কষ্টের শেষ নেই। চোখ হারিয়ে অন্ধত্ব বরণের পর তাকে ছেড়ে চলে গেছেন স্ত্রীও। দেনমোহরের টাকা নিয়ে আপস মীমাংসা করে মাহবুবকে ছেড়ে চলে যান তিনি। এত কষ্ট কোথায় রাখবেন মাহবুব এমনটাই জানালেন তার পরিবার। নারায়ণগঞ্জ শহরের মিশনপাড়া বাসায় কথা হয় মাহবুরের পরিবারের সাথে।
আলাপকালে জানা গেছে, মাহবুব আলমের বাবা মশিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙা থানার রায়পাড়া এলাকায়। কয়েক যুগ ধরে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছেন তারা। ব্যবসা করছেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে। গত বছর হার্ট অ্যাটাকের পর মশিউর রহমান আগের মতো ব্যবসায়ে সময় দিতে পারেন না।
নিজের ছেলের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে তিনি বলেন, মাহবুবের মুখমণ্ডলে প্রায় ৪০ টি ছররা গুলী লেগেছে। বাম চোখের ভেতর ৭ টি গুলী লাগে। মাথা থেকে চোখের সাথে সংযুক্ত নার্ভে গুলী লাগার ফলে মাহবুব কোন চোখেই দেখতে পায় না।
মাহবুব হতাশ হয়ে পড়লেও আশা দেখছেন তার বাবা মশিউর রহমান। তিনি বলেন, মাহবুবের চোখের চিকিৎসা আমেরিকায় আছে বলে জেনেছি। কিন্তু এর খরচ প্রচুর। সরকার সহায়তা করলে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে মাহবুবের চোখের আলো ফেরানো সম্ভব।
গত ১৮ জুলাই, সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জের বাতাসেও বইছিল আন্দোলনের দমকা হাওয়া। সেইদিনের ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করে মাহবুব আলম বলেন, ‘শুরু থেকে আমি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম না। কিন্তু আবু সাঈদকে হত্যার পর আর ঘরে থাকতে পারিনি। একটা জলজ্যান্ত নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলল, এটা আর মেনে নিতে পারিনি।
চাষাড়ায় ওইদিন স্কুল কলেজসহ সকল বয়সী মানুষ আন্দোলন করছিল। এরমধ্যে হঠাৎ তখন প্রাইম হাসপাতালের সামনে একজন হিট স্ট্রোক করে, সেখানে গিয়ে ওরে ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ও ছাত্রদের মাঝে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে। আমি সেসময় কয়েকজনের সাথে হকার্স মার্কেটের ভেতরে ঢুকি। গুলীর আওয়াজ বন্ধ হওয়ায় পুলিশ চলে গেছে কিনা সেটা দেখতে মাথাটা বের করেছিলাম, সেই মুহূর্তেই মুখে গুলী লাগে। চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। তখন এরপর আর চোখে কিছু দেখতে পাইনি।’ কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মাহবুব।
আহত জুলাই বীর মাহবুব আক্ষেপ করেই বলেন,জুলাই আন্দোলনে আমার সব স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। আমার প্রিয়তমা স্ত্রীও আমি অন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাকে ফেলে চলে গেলো। আমি এখন পরিবারের অনেকটা বোঝা হয়ে বেচে আছি দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে।
আহত মাহবুবের মা হালিমা বেগম বলেন ছেলের চোখ ঠিক করতে দেশের সব কয়টা ভালো ভালো হাসপাতালে গিয়েছি। বিদেশেও গিয়েছি। কিন্তু তেমন আশা পাইনি। মাহবুবের চোখে যখন গুলী লাগে। তখন দেশের এমন একটা অবস্থা! মানুষ সরকারি হাসপাতাল সহ অনেক হাসপাতালেই কোন চিকিৎসা পায়নি। এতো এতো রোগী, কিন্তু শুক্রবার সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখছিল না, ছুটি কাটাচ্ছিল। চিকিৎসার অভাবে ছেলের চোখ মুখ ফুলে গিয়েছিল। আমাদের ভিসা থাকায় ওরে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। ২৩ দিন সেখানে চিকিৎসা করে কিছুটা সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসি। কিন্তু চোখে দেখতে পাওয়ার কোন আশা পাইনি সেখানে। এরপর থাইল্যান্ড যাই, সেখান থেকেও কোন রিস্ক নেননি তারা। দেশে ফেরার পর চোখের ভেতর কিছু রক্ত জমাট ছিল, চোখের পর্দা সরে গিয়েছিল, সেগুলো অপারেশন করে ঠিক করেছে। কিন্তু এখনো চোখে ও মাথায় প্রায়ই তীব্র যন্ত্রণা হয় আমার ছেলের।’
হতাশায় অশ্রু ভেজা চোখ নিয়ে হালিমা বেগম বলেন, ছেলের চিকিৎসায় প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু কোন আশা দেয়নি ডাক্তাররা। এদিকে আমার স্বামী গত রোজায় হার্ট অ্যাটাক করে। তার অপারেশন করার কথা ছিল জুলাই মাসে। কিন্তু এই ঘটনার পর সে ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। তার চিকিৎসার টাকাও ছেলের পেছনে খরচ করেছে। ওর ডান চোখে গুলি লাগেনি। এই চোখটা ঠিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে পরিবারের ছোট বড় অনেক কাজ আমার ছেলেটাই দেখত। ওনার অপারেশন ইন্ডিয়ায় করার কথা ছিল, ছেলেটা ছাড়া কিভাবে কি ব্যবস্থা করব আমি জানি না। তারে দ্রুত অপারেশন করে হার্টে রিং পরাতে বলছিল ডাক্তারেরা, কখন কি হয়, ভয় লাগে। আমার দুটো ছোট মেয়ে আছে। চিন্তায় আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার ছেলের জীবনডা কীভাবে যাবে, দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না- এটা বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি। এদিকে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে মাহবুবকে এক লক্ষ টাকা দিয়েছে। আর জেলা প্রশাসক দিয়েছেন বিশ হাজার টাকা।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসক তার কার্যালয়ে ডেকে এনে আহত এই জুলাই বীর মাহবুবকে আর্থিক সহায়তার চেক হস্তান্তর করেন ডিসি। এ সময় জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আপনাদের মতো হাজার হাজার জুলাই বীরদের আত্মত্যাগের কারনেই আজকের নতুন বাংলাদেশ এবং আমি এই দায়িত্বে আসতে পেরেছি।
জুলাই বিপ্লবের সবার আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আগামী প্রজন্মও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে শহীদ আবু সাঈদ,শহীদ মুগ্ধদের মতো যারা জীবন দিয়েছেন এবং আপনাদের মতো যারা সারাজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংগ হারাতে বসেছেন তাদেরকে।
জেলা প্রশাসক এই সময় আবেগী কন্ঠে বলেন,আপনাদের ঋণ শুধু রাষ্ট্র কেন,কারো পক্ষেই শোধ করা সম্ভব না। তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চটাই করা হবে এই জেলার অধিবাসী জুলাই বিপ্লবের সকল শহীদ এবং আহতদের জন্য।