জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে গত কয়েক দিন ধরে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি আপাতত শেষ হলো।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ এবং দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদলের নেতারা এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) কার্যালয়ে এই সাংবাদিক সম্মেলন হয়।
এতে ব্যবসায়ীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার। সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, দেশের শীর্ষস্থানীয় চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুটওয়্যারের এমডি ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি মির্জা আশিক রানা প্রমুখ।
গত শনিবার থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা শুরু হয়। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা এই কর্মসূচির কারণে ঢাকার এনবিআর ভবন থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা কাস্টমস হাউস, বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া, বুড়িমারীসহ দেশের সব স্থলবন্দর শুল্কস্টেশনে শুল্ক-কর আদায় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। স্থবির হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। অবশ্য গত দেড় মাস ধরে সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কারে দাবিতে আন্দোলন করছেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এর আগে বলা হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা নিরসনে আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ সময় তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তারা শাটডাউন কর্মসূচি পালন করতে চাইলে করুক। রোববার দুপুরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ১ জুলাই তাদের সঙ্গে যে বৈঠক হওয়ার কথা, তা-ও হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। এর আগে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা নিরসনের উপায় খুঁজতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠকে বসার কথা জানায় ব্যবসায়ী নেতারা ও আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তারা।
আন্দোলনে কারণে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ : এদিকে দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ অংশ হিসেবে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ফলে বন্দরে পণ্য খালাস ও জাহাজে তুলতে না পারায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কেবল বৈদেশিক যাত্রীসেবা চালু রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান। অন্যদিকে, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর সদরদপ্তরের সামনে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানের অপসারণের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন। আন্দোলনকারীদের দাবি, চলমান সংকটের পেছনে চেয়ারম্যানের ভূমিকা রয়েছে।
রাজস্ব কার্যক্রম বন্ধ রেখে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে ‘আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ বিধ্বংসী কর্মকা- করছেন তা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, অন্যথায় ‘সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে’। রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান সংকট নিরসনে বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, ‘বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের রাজস্ব সংগ্রহ অনেক কম। এর মূল কারণ হলো আমাদের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার নানা দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার সকল অংশীজনের পরামর্শ অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
‘সরকার গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, রাজস্ব সংস্কারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ নজিরবিহীনভাবে গত ২ মাস ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অন্যায় ও অনৈতিকভাবে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে আন্দোলনের নামে চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে, যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।’
সংস্কারের বিরোধিতা ছাড়াও অর্থবছরের শেষ ২ মাসে তারা রাজস্ব আদায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই তথাকথিত আন্দোলন পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক, যা জাতীয় স্বার্থ ও নাগরিক অধিকারের চরম পরিপন্থি। সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দাবি বিবেচনায় নেওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয় এবং আলোচনায় আসার আহ্বান জানালেও তারা তা অগ্রাহ্য করে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করে তারা আন্দোলনের নামে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছে।’
এ পরিস্থিতিতে, অতিজরুরি আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সকল কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সকল শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ ‘আমরা আশা করি, অনতিবিলম্বে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ বিধ্বংসী কর্মকান্ড থেকে সরে আসবেন। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।’
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঠামোগত সংস্কার এবং চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন। সরকার গত ১২ মে এক অধ্যাদেশ জারি করে এনবিআর এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে। এর পরিবর্তে গঠন করা হয় রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই আন্দোলনে নামেন কর্মকর্তারা।
এনবিআর সংকট সমাধানে ৫ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে সরকার। রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিদ্যমান সংকট দ্রুত নিরসনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে এ কমিটির বিস্তারিত টার্মস অব রেফারেন্স সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থ রক্ষায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণার প্রস্তাব (মন্ত্রিসভায়) অনুমোদন করা হয়েছে।’
অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন ২০২৩ নামের এ আইন অনুযায়ী, বর্তমানে ১৮ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা রয়েছে। যেমন ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, ই-কমার্স ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল সেবা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, সরবরাহ ও বিক্রয় এবং এ-সংক্রান্ত স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ কাজ, স্থল, রেল, জল বা আকাশপথে যাত্রী বা পণ্য পরিবহন, স্থলবন্দর, নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর বা বিমানবন্দরে পণ্য বোঝাই-খালাস, স্থানান্তরসহ সংশ্লিষ্ট বন্দর বা বন্দরসম্পর্কিত পরিষেবা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান এবং ডিসপেনসারি-সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা, ওষুধ উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়সহ এ-সংক্রান্ত অন্যান্য কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা কারখানার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসম্পর্কিত পরিষেবা ইত্যাদি।
এই ১৮ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার সঙ্গে এখন সব কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকেও অত্যাবশ্যক পরিষেবা করার সিদ্ধান্ত জানাল সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি কাজ যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিষেবাকে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। তাতে ওই পরিষেবার ক্ষেত্রে কর্মবিরতি বা আন্দোলন করা যায় না। করলে জেল-জরিমানার বিধান আছে।
এদিকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষিত চাকরির ক্ষেত্রে সরকার ওই চাকরিতে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তিকে কোনো এলাকা বা এলাকাগুলো ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকার জন্য আদেশ দিতে পারবে।
আইন অনুযায়ী, কোনো ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা আবশ্যক বিবেচনা করলে সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দিয়ে এক বা একাধিক অত্যাবশ্যক পরিষেবার ক্ষেত্রে ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে সরকার।
সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে গেলে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া যায়, তা–ও বলা আছে আইনে। চাকরিরত কোনো ব্যক্তি ধর্মঘট শুরু করতে বা চলমান রাখতে পারবেন না। কোনো প্রতিষ্ঠানে লকআউট বা লে-অফ ঘোষণা করা যাবে না। এ আদেশ অমান্য করলে অথবা অমান্য করার জন্য কোনো ব্যক্তিকে প্ররোচিত করলে অথবা কাজ করতে বা কাজ চলমান রাখতে অস্বীকার করলে অথবা যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাজে অনুপস্থিত থাকলে বা চাকরি থেকে পরিত্যাগ করলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অপরাধ অনুযায়ী, ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত কারাদ- দেওয়ার বিধান আছে আইনে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী অর্থদ-েরও বিধান আছে। এ ছাড়া বিভাগীয় ব্যবস্থারও সুযোগ আছে আইনে।