প্রশাসনে দলীয় প্রভাব বিস্তারের সংস্কৃতি চলমান রয়েছে : ড. ইফতেখারুজ্জামান
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আমার লোক, তোমার লোক ডেফিনেটলি এটা আওয়ামী লীগ আমলে ভয়াবহ অবস্থায় গিয়েছে। বাংলাদেশে যত খারাপ কাজ, শয়তানি কাজ, সেটা প্রথম আওয়ামী লীগ আমলে শুরু হয়েছে, ৭৩ সালের আওয়ামী লীগের আমলে।
তিনি বলেন, সমস্ত খারাপ কাজ, গুম বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, হেফাজতে নির্যাতন, হেফাজতে মৃত্যু ভুয়া নির্বাচন, দলীয়করণ, সবকিছু শুরু করেছে আওয়ামী লীগ, বাকিরা কন্টিনিউ করেছে।’
গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, আমার লোক, তোমার লোক’ কালচার থেকে বিএনপি ও জামায়াতের মতো বড় দলগুলোকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ছোট দলগুলোও এই ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়। এনসিপি এবং ছোট দলগুলোকেও এই কালচার (আমার দল, তোমার দল) কালচার থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ছোট দলগুলো বা উদীয়মান দলগুলো এ ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়।
সাম্প্রতিক কালে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বদলি নিয়ে বড় দুই দল থেকে টেলিফোনে কল পাওয়ার দাবি করে আইন উপদেষ্টা প্রশাসনে এমন প্রবণতা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেরিয়ে আসার এই আহ্বান জানান।
‘আমার লোক, তোমার লোক’ সংস্কৃতি নাগরিক সমাজের মধ্যেও থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগ আমলে সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদ আক্তান্ত হওয়ার পর কোনো প্রতিবাদ না হওয়ার কথা বলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশকে একটি ‘নির্মম, অত্যাচারী, পাশবিক, দানবীয় বাহিনী’তে পরিণত করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পুলিশি নির্যাতনের নানা দিক তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘একটা সরকারি দলের আদেশে, সরকারি দলের ইচ্ছাপূরণের জন্য। কেউ কেউ করে নিজ স্বভাবে, সে ক্ষমতাশালী হতে চায়, টাকা বানাতে চায়। সরকার তাকে যতটুকু অত্যাচার করতে বলে, তার থেকেও দশগুণ বেশি করে। নিজ স্বভাবের উদাহরণ হিসেবে তিনি সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কথা বলেন।
প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি ফরেনসিক সুবিধা না থাকাকেও অত্যাচারের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে অত্যাচার করা হয় অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য, এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ।’
এখন কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই পুলিশ সংস্কারে সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি পুলিশ সংস্কার কমিশন ও পুলিশের মধ্যে একটি নিবেদিত তদন্ত দল বা সংস্থা গঠনের কথা বলেন।
পুলিশের হাতে নাগরিকদের নির্যাতন বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, ‘এর মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে, ১২ ঘণ্টার মধ্যে আটক করা ব্যক্তির স্বজনদের জানাতে হবে। এছাড়া গুমসংক্রান্ত আইনে সংশোধন করা হয়েছে, যাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে। এটি না হলে গুম হিসেবে গণ্য হবে।পুলিশ সংস্কার কমিশনের ক্ষমতা কাঠামো না থাকার যে সমালোচনা, তা নিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ক্ষমতা থাকলেই কেউ মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করবে, তা ঠিক নয়।’
পুলিশের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্যই কিছু লোক থাকে, তাদের কাজই গার্ড অব অনার দেওয়া। নিষেধ করলে তারা মন খারাপ করে। এ সংস্কৃতি বন্ধে কাজ করতে হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড, ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিশ্চিত না হলে চলমান পুলিশ সংস্কার উদ্যোগ অর্জিত হবে না।’
গণঅভ্যুত্থানের পর এখনো প্রশাসনে দলীয় প্রভাব বিস্তারের সংস্কৃতি চলমান রয়েছে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখনো নিয়োগ পদোন্নতি থেকে শুরু করে কাকে ত্যাগ করা হবে, কাকে ত্যাগ করা হবে না, মামলাবাণিজ্য, গ্রেফতার ও জামিনবাণিজ্য সবকিছু চলছে। নিঃসন্দেহে কোনো ডাউট নেই এবং এটা অব্যাহত থাকবে।’
নবেম্বর থেকে পুলিশের নতুন পোশাক যুক্ত করার কথা রয়েছে, বলেন ইফতেখারুজ্জামান। তবে তিনি মনে করেন, নতুন পোশাকের চেয়েও পুলিশের বাসস্থান ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নে নজর দেওয়া বেশি জরুরি। তিনি মিরপুরের একটি পুলিশ ব্যারাকের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে ২০০ কর্মীর জন্য একটি বাথরুম। ৬০ স্কয়ার ফিটের একটি ঘরে ২০ জন ঘুমায়।
এই অবস্থার জন্য শুধু রাজনৈতিক প্রভাব দায়ী নয় বলে মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘কোশ্চেন পুলিশের নতুন পোশাক ইম্পর্ট্যান্ট বাট ইজ ইট মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান দ্যাট দ্য কন্ডিশন অব দেওয়ার ব্যারাক।’
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সময়ে মাঠপর্যায়ে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের সংস্কৃতি নিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ শুধু ব্যবহৃত হয়েছে বিষয়টি এমন নয়; বরং তারা এটাকে উপভোগ করেছে। তিনি মনে করেন, ‘এই ক্ষমতা ব্যবহার করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও নিয়েছেন। ফলে কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তনও জরুরি।