চব্বিশের জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় মামলা রুজু করা হয়েছে এক হাজার ৭ শত ৩৫ টি। এসব মামলার মধ্যে হত্যা মামলাই ৭ শত ৫০ টি। বাকী ৯ শত ৮৫ টি মামলা অন্যান্য ঘটনায়। এর মধ্যে এ যাবৎ ১৯ টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে আদালতে। যার মধ্যে হত্যা মামলা ৬টি এবং অন্যান্য ধারায় ১৩টি মামলা রয়েছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এ পরিসংখ্যান পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে কোনটি থানায় আবার কোনটি আদালতে হয়েছে। এসব মামলা থানা পুলিশের বাইরে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তদন্ত করছে। তবে, বেশিরভাগ মামলাই তদন্ত করছে থানা পুলিশ। সূত্র মতে, ১৮৭ টি স্পর্শকাতর হত্যা মামলা তদন্ত করছে বিভিন্ন ইউনিট। এর মধ্যে অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি করছে ৬৫ টি হত্যা মামলার তদন্ত, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন-পিবিআই করছে ৬৪ টি হত্যা মামলার তদন্ত, এন্টি টেরোরিজম ইউনিট-এটিইউ করছে ৪৯ হত্যা মামলার তদন্ত ও এলিট ফোর্স র‌্যাব করছে ৯ টি হত্যা মামলার তদন্ত।

পুলিশ সূত্রের দাবি, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকালে দায়েরকৃত মামলার যথাযথ তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা মামলাসমূহ তদারক করছেন। দায়ের করা অন্য সব মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে বলেও দাবি করে পুলিশ সদর দফতর।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে হওয়া ১ হাজার ৭৩৫ মামলার মধ্যে ৭৫০ টি হচ্ছে হত্যা মামলা। এসব মামলা বিশেষভাবে তদারকি করছে পুলিশ সদর দফতর। এর মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। পর্যায়ক্রমে এসব মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

হত্যা মামলাগুলো হয়েছে মূলত: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় নির্বিচার গুলী ও হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করার ঘটনায়। বাকীগুলো হয়েছে অন্যান্য ধারায়।

সূত্র জানায়, গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে হওয়া মামলা তদারকে বিশেষ মনিটরিং দল গঠন করে পুলিশ সদর দফতর। বর্তমানে সারা দেশে ১০টি ‘মেন্টরিং অ্যান্ড মনিটরিং’ দলের মাধ্যমে মামলাগুলো তদারক করা হচ্ছে। এর মধ্যে আট বিভাগে আটটি, রাজধানীতে একটি ও গাজীপুরের জন্য একটি দল করা হয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) প্রতিটি মনিটরিং দল নিয়ে বৈঠকে বসে মামলাগুলো বিশ্লেষণ করছেন। এ যাবত ৮৬ টি বৈঠক হয়েছে বলে জানা গেছে। তা ছাড়া ঢালাও বা হয়রানিমূলক আসামী করার বিষয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) সমন্বয়ে এবং মহানগরের ক্ষেত্রে পুলিশ কমিশনার ও বিভাগীয় কমিশনারের সমন্বয়ে কমিটি করা হয়েছে। এসব কমিটি তদন্তে অগ্রগতির বিষয়গুলোও পর্যবেক্ষণ করছে। এতে বেশ কিছু মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

আন্দোলনের সময় হত্যা ও হত্যাচেষ্টা অভিযোগে ৫ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত রাজধানীর ৫০ থানায় মামলা দায়ের হয় ৭১০ টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে। মামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক মন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক এমপি মমতাজ বেগম, এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়, কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, আব্দুস সোবহান গোলাপ, আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাসহ ৫ হাজার ৭৯ জন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। গ্রেফতার হন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি মো. শহিদুল হক ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ২৩ জন পুলিশ সদস্য।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আলোচিত যারা

সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক সদস্যদের মধ্যে অন্তত ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েল, পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোল্যা নজরুল ইসলাম, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক সহকারী কমিশনার জাবেদ ইকবাল, রাঙামাটি ট্রেনিং সেন্টারের সাবেক পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লা, মিরপুর বিভাগের সাবেক এডিসি মইনুল ইসলাম, বরিশাল রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন, সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, সাবেক এসি তানজিল আহমেদ।

পলাতক আসামীদের মধ্যে একটি অংশ বিদেশে চলে গেছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, হাছান মাহমুদ, তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, বেনজীর আহমেদকে ফিরিয়ে আনতে তাদের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করে সরকার।

পলাতক যত পলাতক আসামীদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, হাছান মাহমুদ, তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বেনজীর আহমেদ, হাসান মাহমুদ খন্দকার, মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও ইমরান এইচ সরকার। এ ছাড়া পলাতক রয়েছেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মেহেদী হাসান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল প্রমুখ।