১৬ বছরে বিএসএফের হাতে নিহত ৬০০ বাংলাদেশী

সীমান্তে কিছুদিন পরপরই বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলী করে হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি কোনো কাজে আসছে না। এর মাঝে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বাংলাদেশীদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানোর ঘটনা। ৫ আগস্টের পর ভারত-বাংলাদেশের পুরো সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলেও বিএসএফ মারমুখি অবস্থানেই আছে। বিএসএফ এর কর্মকান্ডে সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েই চলছে। এখন পর্যন্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কোনো ভারতীয় নাগরিককে দেখামাত্র গুলী ছোড়েনি। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারাও বিনা কারণে সীমান্তের ওপারের কেনো নাগরিকের ওপর চড়াও হয়নি। তারপরও বিনা উস্কানিতে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশীদের টার্গেট করে হত্যা ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটিয়েই যাচ্ছে।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের বিরলের ধর্মজৈন সীমান্ত থেকে দুই বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হয়। এর আগে এক বাংলাদেশী কৃষককে ভারতে আটক করে নির্মম নির্যাতন চালানোর ঘটনা ভাইরাল হয়। এর একদিন পর বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিতে এসে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে আটক হয়। পরবর্তীতে পতাকা বৈঠকের পর ফেরত দেয়া হয়। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে পাঁচ বাংলাদেশীকে গুলী করে হত্যা করেছে বিএসএফ। এসময় ১০ জন আহত হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধের উদ্যোগ নেয়। বিএসএফ এর গুলীতে বাংলাদেশীদের হত্যার নিন্দা জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সীমান্তে হত্যাকাণ্ডকে ‘নিষ্ঠুরতা’ আখ্যায়িত করে তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে সীমান্তে বড় কোনো উত্তেজনা তৈরি হয়নি বলে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বিজিবি কখনো সীমান্তে পিঠ দেখাবে না, বুক দেখাবে। বিজিবিকে বলা হয়েছে, সীমান্তের যেকোনো ধরনের উত্তেজনায় কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। এছাড়া ভবিষ্যতে যাতে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনা আর না ঘটে সে বিষয়ে বাংলাদেশের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

এদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের নয়াদিল্লীতে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি বিজিবির পক্ষ থেকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তোলা হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে বিএসএফের মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরী বলেন, সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে বিজিবিকে বারবার বলা হয়। কিন্তু তবু দীর্ঘ সীমান্তের কোথাও কোথাও দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় থাকে। বিএসএফ সতর্কভাবে তাদের মোকাবিলা করে। প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার নীতি থেকে বিএসএফ সরেনি বলে উল্লেখ করেন দলজিৎ সিং চৌধুরী। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে চার দিনব্যাপী সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত চারদিনের সম্মেলনে দুই দেশ সীমান্ত হত্যার ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনাসহ বেশ কিছু বিষয়ে একমত হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের নিহতের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশসহ হত্যার ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি জোর আহ্বান জানান। এ ছাড়া আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম সীমান্তের শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরে সীমান্তে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার বিষয়ে বিএসএফ মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ১৮টি হামলার ঘটনায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে পাঁচজন বাংলাদেশী নিহত, ১০ জন আহত ও ১৫ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এইচআরএসএস জানিয়েছে, সিলেট সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়াদের গুলীতে শাহেদ আহমদ (২৫) নামে এক বাংলাদেশী তরুণ নিহত এবং অন্য ঘটনায় গুলীবিদ্ধ হয়ে দু’জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে এক বাংলাদেশী যুবককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে ভারতীয় নাগরিকরা। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা সীমান্ত থেকে নাজিমুদ্দিন নামে এক যুবকের এবং কুমিল্লা সীমান্তে গোমতি নদীর পাড় থেকে কাজী ছবির নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির গুলীতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে দু’জন আহত হয়েছেন। জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলী ও মর্টারশেল বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় এসে পড়ায় স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে এক আনসার সদস্যসহ ছয়জন বাংলাদেশী আহত হয়েছেন।

১৬ বছরে নিহত প্রায় ৬০০ বাংলাদেশী : গত ১৬ বছরে প্রায় ছয়শ’ বাংলাদেশী হত্যা হয়েছে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলী কিংবা নির্যাতনে। প্রতিবেশী বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হলেও অন্য প্রতিবেশী চীন বা নেপাল সীমান্তে তা অসম্ভব। দাদাগিরি ফলাতে বাংলাদেশ অংশে সীমান্ত হত্যায় আন্তর্জাতিক আইন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির তোয়াক্কা করছে না ভারত। দেশী-বিদেশী চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের ভেতরে এ ইস্যুতে জনমত গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে একজন বাংলাদেশীকে আটকের পর উলঙ্গ করে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। বারো বছর আগে এমন ভিডিও নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে দেশের মানুষ। বন্ধু রাষ্ট্রের বিএসএফ সদস্যের এমন নিষ্ঠুর নির্যাতন দেশবাসীকে হতবিহ্বল করেছে। ভাবিয়েছে ভারতের বিবেকবানদেরও। এরপর সীমান্তে ১৩ বছরের কিশোরী ফেলানিকে হত্যার পর কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখার দৃশ্যও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। মানবাধিকার সংগঠন-অধিকার এর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের নবেম্বর পর্যন্ত ১৯ জন বাংলাদশীকে সীমান্তে বিএসএফ গুলী কিংবা নির্যাতন করে হত্যা করেছে। একইভাবে, ২০২৩ সালে ২৮ জন, ২০২২ সালে ১৮ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন হত্যা করা হয়। এছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫০৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে বিএসএফ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সংখ্যায় কমলেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। এতো হত্যার পরও বিবেক নাড়া দেয়নি বিএসএফ সদস্যদের। ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ প্রধানদের বৈঠকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেনি ভারত। বরং চোরাচালান ও আত্মরক্ষার অজুহাতে একের পর এক হত্যায় ব্যস্ত দেশটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বাস্তবতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে মেলালে চলবে না। দেখতে হবে ভিন্ন দৃষ্টিতে। সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের এক একটি ঘটনার পর সরকার নড়েচড়ে বসলেও, তীব্র সমালোচনা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না বলে আক্ষেপ তাদের। পাঁচ আগস্ট পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় সীমান্ত রক্ষায় অন্তবর্তী সরকারের কঠোর অবস্থান বিজিবির মনোবল বাড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সীমান্ত হত্যা বন্ধে আলাদা কমিশন গঠনের পরামর্শ বিশ্লেষকদের।

দুই বাংলাদেশীকে ধরে নেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয় : দিনাজপুরের বিরলের ধর্মজৈন সীমান্ত থেকে দুই বাংলাদেশী নাগরিককে বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়। এর প্রতিবাদে দুই ভারতীয় নাগরিককে ধরে এনে আটকে রেখেছেন বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বিরল উপজেলার ধর্মজৈন সীমান্ত এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটেছে। বিএসএফের হাতে আটক বাংলাদেশীরা হলেন-ওই এলাকার ইসরাইল ইসলামের ছেলে এনামুল ইসলাম (৫০) ও তার ছেলে মাসুম (১৫)। স্থানীয়রা জানান, বিরলের ধর্মপুর ইউনিয়নের ধর্মজৈন সীমান্তে ধান কাটছিলেন মাসুদ ও এনামুল নামের দুই কৃষক। দুপুর ১২টার দিকে ৩২০ মেইন পিলারের সাব পিলার ৯ ও ১০ এর মাঝামাঝি থেকে তাদের ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। এ ঘটনার প্রতিবাদে দুই ভারতীয় নাগরিককে ধরে এনে আটকে রেখেছেন স্থানীয় গ্রামবাসী। আটক দুই ভারতীয় নাগরিক হলেন- অবিনাশ টুডু ও ফিলিপ সরেন। তাদেরকে কারুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে বিজিবি বা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বাংলাদেশী দুই নাগরিককে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে দুই ভারতীয় নাগরিককে ধরে নিয়ে আসে গ্রামবাসী। পরে সেখানে বিজিবি সদস্যরা আসলে তাদের কাছে ওই দুই ভারতীয় নাগরিককে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিরল থানার ওসি আব্দুস সবুর বলেন, পতাকা বৈঠক করে বিজিবি-বিএসএফ বিষয়টির সমাধান করবে। ধর্মজৈন বিওপি ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার রেজাউল করিম বলেন, সীমান্তে ধান কাটার সময় দুই বাংলাদেশী নাগরিককে তুলে নিয়ে যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। পরে স্থানীয় বাংলাদেশী নাগরিকরা দুই ভারতীয় নাগরিককে আটক করেন। আমরা ইতোমধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি। পতাকা বৈঠকের পর রাতে তাদের ছেড়ে দেয় বিএসএফ।

এরআগে ঝিনাইদহের মহেশপুরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে রিয়াজ (২০) নামের এক বাংলাদেশী যুবক আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১ মে) রাতে উপজেলার কুসুমপুর বিওপির পিপুলবাড়িয়া সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। আহত রিয়াজ উপজেলার পিপুলবাড়িয়া গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে। রিয়াজের চাচাতো ভাই সুমন জানান, রাতে রিয়াজ সীমান্তের খালের ধারের মাঠের জমিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য যান। সেসময় বিএসএফ তাকে লক্ষ্য করে গুলী ছোঁড়ে। এতে গুলীবিদ্ধ হয়ে রিয়াজ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা গুলীর শব্দ শুনে মাঠে গিয়ে রিয়াজকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পরে রাতেই রিয়াজকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ইমন হোসেন জানান, রিয়াজের শরীর থেকে ছররা গুলীর কিছু অংশ বের করা হয়েছে। তবে একটি গুলী কিডনির পাশ দিয়ে ঢুকে গেছে।