২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শহীদ শিশু-কিশোরদের আত্মত্যাগের কথা ভুলবে না বাংলাদেশ। তাদের আত্মত্যাগের মহিমা ধারণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জুলাই বিপ্লবে শহীদ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। জুলাই বিপ্লবে মাদ্রাসার শিশু শিক্ষার্থীদের অবদানের কথা আমরা যেন ভুলে না যায়। শিশুরাই জুলাই গণহত্যায় নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। তেমনিই এক বীর শহীদ জোবায়ের হোসেন ইমন ছিলেন ১৪ বছরের বালক। বয়সের দিক থেকে শিশু হলেও তার মেধা, নীতি-নৈতিকতা, সততা ও ভালো মন্দের জ্ঞান বেশ পরিপক্ক। খুনি হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনী, পুলিশ লীগ দেশব্যাপী ক্রাকডাউন পরিচালনা করছিল। রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগ। কোলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্কদের জীবন দিতে হয়েছে। বুলেট, টিয়ারশেল, ছররাগুলী, রাবার বুলেট কোন কিছুই তাদের বাধা হতে পারেনি। নির্বিচারে শত শত মানুষকে হত্যার মিশন নিয়ে নেমেছিল খুনি হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনী। তবুও এদেশের বীর সন্তানেরা কেউ পিছপা হয়নি। নিজেদের পিঠ প্রদর্শন করেনি। এরই অংশ হয়েছে শহীদ ইমন।
১৯ জুলাই ২০২৪ ইং তারিখটি ছিল শুক্রবার। জুমার আজান হলে, শহীদ ইমন গোসল করে, পাঞ্জাবি পায়জামা পরে আনন্দচিত্তে উৎফুল্ল মনে নামায পড়তে যায়। কে জানতো যে, এই শিশুটির জন্য এটিই হবে শেষ নামায। সে সবার থেকে শুনে শুনে নিজেও শ্লোগান দিত ‘কোটা না মেধা? মেধা মেধা।’ এই স্লোগান দিতে দিতে মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদের কাছে আসলে হেলিকপ্টার থেকে একটি বুলেট এসে কেড়ে নেয় ইমনের স্বপ্ন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকা, ফেসবুক ও ইউটিউবে মুক্ত সংবাদের প্রবাহে বিঘœ ঘটার পাশাপাশি সরকারি গণমাধ্যমের নির্লজ্জ নীরবতায় গুম করা হয়েছে এমনি শতশত নৃশংসতার ঘটনা। তবুও ছাত্রজনতার বিপ্লবী প্রতিরোধে সফল হয়েছে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু কেড়ে নিয়েছে অগণিত তাজা প্রাণ। সেখানে অবুঝ শিশুদের সংখ্যাটা এতো বড় হবে এটা খোদ সরকারের মধ্যে থাকা অনেক বিবেকবান ব্যক্তিও মেনে নিতে পারছেন না।
শিশু হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার এখন পুরো দেশ ও জাতি। প্রবাসীরাও ক্ষিপ্ত হয়ে শুরু করেছেন রেমিট্যান্স শাটডাউন। তাঁরা যেভাবেই হোক এই শিশু কিশোরদের হত্যার বিচার চান। তাঁরা বিচার চান সেই ঘৃণ্য স্বৈরাচারের যাদের হাতে আমার আপনার সন্তানের রক্ত, শিশু কিশোরদের রক্ত মেখে ক্লেদাক্ত। শিশু গণহত্যার দায়ে স্বৈরাচার হাসিনা ও তাঁর দোসরদের বিচার করতে হবে। কারণ দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন, ব্যাপক দুর্নীতি এবং শেষের ৩৬ দিনে অবদমন ও হত্যার মাধ্যমে ‘রেডলাইন ক্রস’। রেডলাইন ক্রসের বড়ো চিত্র হলো নির্বিচারে গুলীবর্ষণ। গুলীতে ছাদে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশুরা পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়। নির্বিচারে ছররা গুলী মেরে সাধারণ মানুষের বুক ঝাঁঝরা করা কিংবা চোখ নষ্ট করে দেয়া, এসবই হয়েছে ফ্যাসিস্ট অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। সাথে যোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও। অভিযোগ আছে এই গণহত্যায় ভারতীয় বাহিনীও অংশ নিয়েছিল।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে জুলাই সহিংসতায় অন্তত ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। (যদিও এ সংখ্যা শতাধিক)। শিশুদের মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়ে ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সঞ্জয় উইজেসেকেরা বলেছেন, শিশুদের সবসময় সুরক্ষিত রাখতে হবে। এটা সবার দায়িত্ব। তিনি আরো বলেন, অনেক শিশু আহত হয়েছে এবং অনেককে আটক করা হয়েছে। শিশুদের মৃত্যু ভয়ানক ক্ষতি। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফ তো শিশুদের সুরক্ষার কথা বললো, শিশুদের মৃত্যু এক ভয়ানক ক্ষতি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকার কি তা উপলব্ধি করে? ওরাতো ক্ষমতার মোহ ও দম্ভে অন্ধ থাকে। ফ্যাসিস্ট শাসনে শিশুরা বেড়ে ওঠার কাক্সিক্ষত পরিবেশ পায় না। ওদের শাসনে ছোট-বড়ো কেউই ভালো থাকে না। তাইতো আমরা দেখলাম ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান।
শহীদ জোবায়ের হোসেন ইমনের জন্ম ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখ। পিতা : মো. কাঞ্চন মিয়া (৪০) পেশায় একজন ভ্যান চালক, মা : মশা জহুরা খাতুন (৩৬) একজন গৃহিণী। বর্তমান ঠিকানা : ৩২/১১, আই সুলতানগঞ্জ, এলাকা: মেকআপ খান রোড, থানা: রায়ের বাজার, জেলা: ঢাকা। স্থায়ী ঠিকানা: কিশোরগঞ্জ জেলা। মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদের সামনে ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩ টায় হেলিকপ্টার থেকে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলীতে আহত হয়। একই দিন সন্ধ্যা ৭ টা ইবনে সিনা হাসপাতাল, ধানম-িতে শাহাদাতবরণ করেন। শহীদ জোবায়ের হোসেন ইমনকে কিশোরগঞ্জে তাঁর গ্রামের বাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে কিশোর ইমন বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের প্রাণ। তার পুরো নাম শহীদ জোবায়ের হোসেন ইমন। শহীদ ইমন ৪র্থ শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী। সে দারুন নাজাত ইসলামিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন করত। চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী হলেও সে ছিল অত্যন্ত মেধাবী বালক। শহীদ ইমনের পরিবার কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ২৫ বছর আগে। পিতার স্বপ্ন ছিল ঢাকায় গিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাবেন বা ভালো একটি কাজের ব্যবস্থা করবেন। পিতামাতার স্বপ্নের পথেই হাঁটছিল শহীদ ইমন। সে তার মাদরাসার সব ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিল অনন্য। অন্যদের থেকে ছিলো আলাদা। ছোটকাল থেকেই সে প্রচ- সাহসী ছেলে। শৈশব থেকেই ভালো-মন্দ, ন্যায় অন্যায় ইত্যাদীর প্রতি খুবই সচেতন ছিল ইমন। সে প্রতি ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে আদায় করার চেষ্টা করতো। তাকে ঘিরে পিতার যে স্বপ্ন ছিল তা পূরণের সূচনা হয়েছিল মাত্র। তবে এগুতে পারলো না। পুলিশ লীগ, আওয়ামী লীগ, টোকাই লীগ, সন্ত্রাসী লীগ, যুবলীগের জঙ্গীরা সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। পরিবার এখন তার শোকে কাতর। ইমনের মতো একটি কিশোরের সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সেবা থেকে বঞ্চিত হলো বাংলাদেশ।
শহীদ সংক্রান্ত ঘটনার বর্ণনা: ১৯ জুলাই ২০২৪ জুমার নামায শেষে মোহাম্মাদপুরস্থ রায়বাজার এলাকাসংলগ্ন কবরস্থান মসজিদের সামনে থেকেই ছাত্র জনতার প্রতিবাদী মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে ছোট্ট ইমন ও তার বন্ধুরাও যুক্ত হয়। মিছিলটি আল্লাহ করিম মসজিদের সামনে গেলে শুরু হয় সন্ত্রাসী বাহিনীর আক্রমণ। তারা শুধু নিচ থেকে বুলেট, টিয়ারশেল, গুলী ছোড়েনি বরং রক্তপিপাসু হাসিনার লেলিয়ে দেয়া পুলিশ ও র্যাবের সন্ত্রাসীরা আকাশ থেকে নিক্ষেপ করে বুলেট। বৃষ্টির ন্যায় আসতে থাকে বুলেট। আন্দোলনকারীরা তখন নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য আশেপাশে আশ্রয় নিলেও কিছু আন্দোলনকারী গুলীবিদ্ধ হন। তখন সময় ছিল আনুমানিক বিকাল ৩.৩০। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলীর শিকার হন শহীদ ইমন। গুলী বাম কানের নিচ দিয়ে ঢুকে ডান চোয়ালের নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলীবিদ্ধ বালককে উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন। তাকে ধানমন্ডি শংকরস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রচ- বক্তক্ষরণের কারণে এই নিরপরাধ-নিষ্পাপ ছেলেটি সন্ধ্যা ৭.৩০টার দিকে শাহাদাৎবরণ করেন। তার অপরাধ সংঘটিত করার বয়সই হয়নি। এরপরও ফ্যাসিস্ট, খুনি, মানবতাবিরোধী হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনী তাকে হত্যা করেছে। দেশের জন্য শহীদ ইমন নিজেকে উৎসর্গ করেছে। সে পথ দেখিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। তার এই আত্মত্যাগে আগস্ট মাসের ৫ তারিখে পতন ঘটেছে খুনি হাসিনার। শহীদ ইমন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে আজীবন।
শহীদ পরিবারের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা: শহীদ জোবায়ের হোসেন ইমনের বাবার কোন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নেই। বস্তিতেই তিনি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। তিনি পেশায় একজন ভ্যান চালক। কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে ঢাকায় আসেন জীবিকার সন্ধানে। তাঁরা দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ ঢাকাতে অবস্থান করছেন। তার চার ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মুহাম্মদ জিহাদ (২১)-লেগুনার হেলপার। বড় মেয়ে স্বর্ণা আক্তার কানসি (১৯) বিবাহিতা এবং ছোট মেয়ে সুবর্ণা আক্তার বর্ণা (১২) চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বড় ছেলে ও পিতার সামান্য আয় দিয়ে সংসার পরিচালনা খুবই কষ্টকর।
শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা: র্যাবের সাঁজোয়া হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলীতে মোহাম্মদপুর থানার দারুননাজাত ইসলামিয়া মাদ্রাসার ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জোবায়ের হোসেন ইমন নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট ২০২৪) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে মামলাটি করেন নিহত ইমনের মামা আব্দুল্লা আবু সাইদ ভূঁইয়া। আদালত বাদীর জবানবন্দী গ্রহণ করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার অপর আসামীরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. এ আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ড. খ মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিবির সাবেক প্রধান হারুন-অর-রশীদ ও যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। এছাড়া র্যাবের হেলিকপ্টার টহল টিমের অজ্ঞাতনামা সদস্য ও তাদের কমান্ডিং অফিসারদের অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্রসমাজ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করলে ইমন গণআন্দোলনের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে শরীক হয়। আন্দোলনকারীদের নিষ্ঠুরভাবে দমনের জন্য আসামীরা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দেখামাত্র গুলী করে হত্যার নির্দেশ দেন। তাদের এ নির্দেশ পালনের উদ্দেশে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলী চালানোর জন্য নিজ নিজ বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, হারুন-অর-রশীদ, হাবিবুর রহমান। তাদের নির্দেশে বাস্তবায়ন করেন অধস্তন কর্মকর্তারা।