চুক্তি পর্যালোচনায় জাতীয় কমিটি পুনর্গঠন
আদানিসহ অধিকাংশ বিদ্যুৎ চুক্তিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ গঠিত উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারসহ আমলা ও ব্যবসায়ীরাও। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তি হওয়ায় যথাযথ প্রমাণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়।
বিশেষ বিধানে সম্পাদিত বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পর্যালোচনার লক্ষ্যে গঠিত কমিটি ১ বছর পর গতকাল রোববার একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে হস্তান্তর করেছে। এ সময় কমিটির সদস্যরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব তথ্য জানান।
ফাওজুল কবির বলেন, আদানির সঙ্গে করা চুক্তির বিষয়ে যদি দুর্নীতি প্রমাণ হয়, তাহলে সে চুক্তি বাতিল হতে পারে। তবে চুক্তি চাইলেই বাতিল করা যায় না।
তিনি আরও বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে দুদকের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব তথ্য দুদকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
কমিটির প্রধান সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইনের আওতায় বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এই চুক্তি হয়েছে বিভিন্ন দেশের কোম্পানির সঙ্গে। ভারতের আদানিসহ যেসব কোম্পানি এ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। গতকাল রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে। অন্য সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রো-ভিসি আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের প্রাক্তন সিওও আলী আশরাফ, বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল’ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক।
কমিটির কার্যপ্রণালীতে বলা হয়েছে, কমিটি যেকোনো সূত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় যেকোনো নথি নিরীক্ষা করতে পারবে, সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে আহ্বান করতে পারবে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর আওতায় ইতোমধ্যে সম্পাদিত চুক্তিগুলোতে সরকারের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে কি না তা নিরীক্ষা করবে, নিরীক্ষার ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কমিটিকে সাচিবিক ও আনুষঙ্গিক সহায়তা দেবে।
আদানির সঙ্গে চুক্তিতে বড় অনিয়ম, পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষায় দুদক
ভারতের বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে ভয়াবহ অনিয়ম, আর্থিক ফাঁকি ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার তথ্য রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের পর একের পর এক প্রকাশ পাচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই এক চুক্তিতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তত ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে যা টাকার মূল্যে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকারও বেশি।
এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদানি গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তির পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থা চুক্তির আর্থিক, প্রশাসনিক ও আইনগত দিক বিশ্লেষণের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দুদকের উপ-পরিচালক আল-আমিন এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে আরও আছেন উপ-পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ও সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান। তারা তিনজনই সরকারি প্রকিউরমেন্ট ও উচ্চমূল্যের আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল জানিয়েছেন, এই কমিটি আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটি আর্থিক, আইনগত ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে পর্যালোচনা করবে। চুক্তির কাঠামো, শুল্ক ফাঁকির ধরন, কর অব্যাহতির বৈধতা, এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া যাচাই করা হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কোনো ধারা বা অনিয়ম থাকলে তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হবে।
দুদকের এই কমিটিকে ৪৫ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে, তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানেই যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলে, তাহলে দুদক সরাসরি ফৌজদারি তদন্তে যেতে পারবে।
২০২৩ সালের ৯ মার্চ ভারতের ঝাড়খন্ডের গড্ডায় স্থাপিত আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির আওতায় আদানির কেন্দ্র থেকে ১,৬০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ আমদানির কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদ্যুৎ আমদানির সময় আদানিকে শুল্ক ও কর থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল পিডিবির অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই।
প্রতিবেদনে বলা হয় ২০২৩ সাল থেকে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সময় কোনো আমদানি শুল্ক, ভ্যাট বা কর প্রদান করা হয়নি। এনবিআর বা বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদন না নিয়েই পিডিবি একতরফাভাবে শুল্ক অব্যাহতি দিয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
শুল্ক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ প্রবেশের সময় কোনো প্রকার কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স করা হয়নি। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের হিসাবেও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন বা ইলেকট্রনিক ডেটা এন্ট্রি অনুপস্থিত। শুল্ক ফাঁকির এই প্রক্রিয়া নিয়মবহির্ভূত এবং তা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের আর্থিক স্বার্থ ক্ষুণ্ করেছে।”
শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের হিসেবে, ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির গড্ডা কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ মোট ১,০৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ আমদানি করেছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার। এই আমদানিতে ৩১ শতাংশ শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য কর মিলিয়ে প্রায় ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ডলার রাজস্ব পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আদানিকে করমুক্ত সুবিধা দেওয়ায় তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়েনি।