নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হরহামেশা চলছে উল্টো পথে যানবাহন। এতে করে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। হাসপাতালে যাওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনায়ও ঘটছে। বিশেষ করে রাজধানীতে উল্টোপথে অটোরিকশা, মিশুকসহ অন্যান্য ছোট গাড়ির যাতায়াত বেড়েছে। ট্রাফিক পুলিশ মাঝে মধ্যে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে যানবাহন আটকের পর মামলা দায়ের করে; কিন্তু কোনোভাবেই এসব অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না। রাস্তায় চলাচলে মানুষ সচেতন হলেও শুধু উল্টো পথে বেপরোয়া যানবাহন চলাচলের কারণে অজ্ঞাতসারে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

সূত্র জানায়, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা সড়কে রিকশায় করে ডিইপিজেডের দিকে যাচ্ছিলেন এক নারী। সাথে তার চার বছর বয়সী সন্তান ও একজন পুরুষ। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর আশায় শর্টকাট নিতে গিয়ে হুট করে রিকশাটি উঠে পড়ে সড়কের উল্টো পথে।

তবে বাইপাইলের কাছে আসতেই সড়কের জলাবদ্ধ নালায় পড়ে রিকশাটি ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে যায়। তার ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাক তাদের চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই পুরুষটি মারা যান, পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে মারা যান সেই নারী ও শিশু।

সিসিটিভিতে ধরা পড়া এই দুর্ঘটনা রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে ছোট ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন যেমন রিকশা, ব্যাটারি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সড়কের উল্টো পথে চলাচলের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি তুলে ধরে।

সূত্র জানায়, ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা নতুন কিছু নয়। সময় বাঁচানোর অজুহাতে উল্টো পথে গাড়ি চালানোও এখানে বহু দিনের চর্চা। রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে প্রভাবশালী রথী-মহারথীদের গাড়ি উল্টো পথে চলতে দেখা যায় প্রায়ই।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ প্রবণতা আরও তীব্র হয়েছে, বিশেষ করে ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশার বিস্তারের কারণে। সংকীর্ণ গলি ও অভ্যন্তরীণ সড়কে চলাচলের জন্য তৈরি এই ছোট যানবাহনগুলো এখন ঢুকে পড়েছে মহাসড়ক, প্রধান সড়ক, এমনকি উড়ালসেতুতেও। আরও উদ্বেগের বিষয় হলোÑ এগুলো প্রায়শই ট্রাফিকের বিপরীত দিকে চলাচল করছে, যা শুধু আইন লঙ্ঘনই নয়, বরং প্রতিদিনের যাতায়াতকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।

সূত্র জানায়, বহু বছর আগে যানজট নিয়ন্ত্রণ, ওভারটেকিং কমানো এবং সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীতে লেন ব্যবস্থা চালু করে। ওই পরিকল্পনার আওতায় সড়কের প্রতিটি লেন নির্দিষ্ট যানবাহনের জন্য নির্ধারিত হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, দ্রুতগতির যানবাহন যেমন প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও জিপ চলবে দ্রুতগামী লেনে। আর সিএনজি অটোরিকশা, মোটরবাইক ও অন্যান্য অপেক্ষাকৃত ধীরগতির যান থাকবে তৃতীয় (ধীরগতির) লেনে।

তবে বাস্তবে চিত্রটি বেশ ভিন্ন। ব্যাটারি চালিত রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশা প্রায়ই রাজধানীর সড়কে দ্রুতগতির লেন দখল করে চলে। এতে শুধু যান চলাচলে বিশৃঙ্খলাই তৈরি হয় না, বরং পুরো সড়কব্যবস্থায় যানজট আরও বাড়িয়ে দেয়।

এই অটোরিকশার চালকরা শুধু ভুল লেনে চলাচলেই সীমাবদ্ধ থাকেন না। প্রায়ই সড়কের উল্টো পথেও উঠে যান, যা যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মো. শামসুল হক বলেন, একসময় উল্টো পথে গাড়ি চালানো ছিল আইন লঙ্ঘনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখন তা যেন রুটিন চিত্রে পরিণত হয়েছে। রাতের অন্ধকারে যেমন, দিনের আলোতেও এসব যানবাহন বিনা দ্বিধায় উল্টো পথে ছুটছে। এর পেছনে শুধু সময় বাঁচানোর তাগিদ নয়। বরং কারণ বাস্তবে এর জন্য তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা প্রতিকার নেই। নিয়ম ভঙ্গকেই নীরবে মেনে নেওয়া এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, যা প্রতিদিনই নগরবাসীর জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।

তিনি বলেন, ‘ইজি বাইক ও ব্যাটারি চালিত রিকশাগুলোর উদাহরণই ধরুন। এদের এতটাই বিস্তার ঘটেছে যে আইন লঙ্ঘনের দৃশ্য এখন আরও বেশি চোখে পড়ছে। এর ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলাও বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে উল্টো পথে চলা যানবাহন পুরো সড়কের ধারণক্ষমতাকেই গ্রাস করছে।

জানা গেছে, অটোরিকশা ও অনুরূপ ছোট যানবাহনের কারণে সড়কে দুটি বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তারা বৈধ ট্রাফিকের পথ অবরুদ্ধ করে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

প্রথমত, এই যানবাহনগুলো সঠিক পথে চলা গাড়ির গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। নিয়ম মেনে চলা যানবাহনগুলোকে প্রায়ই হঠাৎ ব্রেক টানতে হয়, দিক পরিবর্তন করতে হয়, কিংবা উল্টো দিক থেকে আসা রিকশা পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এতে শুধু যাত্রীর মূল্যবান সময়ই নষ্ট হয় না, সড়কের সক্ষমতাও কমে যায়। ফলে ট্রাফিক ধীর হয়ে পড়ে এবং প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে অনেক দূর পর্যন্ত।

এভাবে সড়কে এক ধরনের অভিশপ্ত চক্র তৈরি হয়েছে। বাস ধীরগতি ও অপ্রত্যাশিত হয়ে যাওয়ায় যাত্রীরা ঝুঁকে পড়ছেন ছোট ও দ্রুতগতির পরিবহনÍযেমন শেয়ার্ড বাইক বা অটোরিকশার দিকে। এর ফলে রাস্তায় এসব যানবাহনের সংখ্যা আর যানজট উভয়ই বাড়ছে ।

দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়েছে। উচ্চগতির সড়কে ক্ষীণ ও ধীরগতির এসব যানবাহনকে এড়াতে গিয়ে প্রায়ই ঘটে যায় প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। বিপরীত দিক থেকে আসা অটোরিকশা বা ইজি বাইকের মুখোমুখি পরিস্থিতিতে চালকদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় থাকে খুবই সীমিত। অনেক ক্ষেত্রেই জরুরি ব্রেক টানার পরও দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না।

জানা গেছে, রিকশা ও অটোরিকশা কাঠামোগতভাবে দুর্বল যানবাহন। এগুলোর চালকদের অনেকেই অপ্রশিক্ষিত, অপ্রাপ্তবয়স্ক বা মৌলিক সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখেন না। অথচ এই যানবাহনগুলো মোটেই হাইওয়েতে চলার জন্য তৈরি নয়। তাই এ ধরনের সড়কে তাদের উপস্থিতি কেবল অবৈধই নয়, মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণও।

জানা গেছে, ঢাকায় বড় দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনামূলক কম, কিন্তু ছোট ছোট সংঘর্ষ প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। গুরুতর দুর্ঘটনা সাধারণত মহাসড়কেই ঘটে। সেসব দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হলো ক্ষীণ ও অরক্ষিত যানবাহনকে এড়ানোর চেষ্টা। বিপরীত দিক থেকে হঠাৎ কোনো যান সামনে এসে পড়লে চালকরা আকস্মিক পরিস্থিতিতে পড়েনÑ যেখানে ব্রেক টানলেও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঠেকানো যায় না।’

ট্রাফিক বিভাগের সতর্কীকরণ

উল্টো পথে যান চলাচল ও অননুমোদিত সড়কে রিকশা চলাচল না করা প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সম্প্রতি এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।

গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে ঢাকা মহানগরীতে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে, রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা বিভিন্ন সড়কে উল্টো পথে চলাচল করে থাকে।

প্রায় সকল ক্ষেত্রে রিকশার যাত্রীগণ রিকশা চালককে উল্টো পথে যেতে প্ররোচিত করে থাকেন। আবার ঢাকা মহানগরীর প্রধান সড়ক বা যে সকল সড়কে বাস চলাচল করে ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যেখানে রিকশা চলাচলের অনুমোদন নেই সে সকল সড়কেও রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রেও যাত্রীগণ রিকশা চালকদের অননুমোদিত সড়কে প্রবেশ করতে প্ররোচিত করে থাকেন। উল্টো পথে এবং অননুমোদিত সড়কে রিকশা চলাচলের ফলে সড়কের স্বাভাবিক যানচলাচল বিঘিœত হয়ে যানজট বৃদ্ধির পাশাপাশি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আবার অনেক সময় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ ও ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ (ঞঅএ) সদস্যদের সঙ্গে অযাচিত বাকবিতন্ডা সৃষ্টি হয়ে সরকারি কাজে বাধা প্রদানের ফলে সংশ্লিষ্ট যাত্রী/চালকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।

একইভাবে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেল এবং অটোরিকশা (সিএনজি চালিত) উল্টো পথে চলাচল করতে দেখা যায়। উল্টো পথে চলাচলের কারণে সড়কে যানজট বৃদ্ধির পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য উল্টো পথে চলাচলকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার সময় অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট যাত্রী/চালক আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য প্রদান করে থাকেন। এরূপ পরিস্থিতিতে ফৌজদারি অপরাধ করার ফলে সংশ্লিষ্ট যাত্রী/চালককে গ্রেফতারপূর্বক আইনের হাতে সোপর্দ করতে হয়।

এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে সরকারি যানবাহন ও বিভিন্ন পেশাজীবী পরিচয় বহনকারী যানবাহন (যেমন- সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নামযুক্ত) বিভিন্ন সড়কে উল্টো পথে চলাচলপূর্বক এবং অবিবেচনাপ্রসূত সড়কে গাড়ি পার্কিং করে যানজট বৃদ্ধি করে থাকে। সম্প্রতি সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা/কর্মচারীগণের উল্টো পথে চলাচলের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতারপূর্বক বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণের মত ঘটনা ঘটেছে।

এমতাবস্থায় ঢাকা মহানগরীর রিকশা যাত্রী, রিকশা চালক, মোটরসাইকেল চালক এবং সরকারি যানবাহন চালকসহ অন্যান্য চালকদের উল্টো পথে না চলাচল করার জন্য এবং যাত্রী সাধারণকে ঝুঁকিপূর্ণ/অননুমোদিত যানবাহনে ভ্রমণ না করার জন্য এবং যাত্রী সাধারণকে উল্টো পথে অননুমোদিত সড়কে চালকদের যান নিয়ে প্রবেশ করতে প্ররোচিত না করার জন্য এবং ট্রাফিক পুলিশ বা ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপের সঙ্গে অযাচিতভাবে বাকবিত-া না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে। এ আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ জোরদার করা হবে। এই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছে।

কী বলে আইন?

আমাদের দেশে রাস্তায় গাড়ি চালাতে হলে যে আইনের আওতায় থাকতে হয়, সেটার নাম হচ্ছে মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩। যদিও পরে ১৯৯০ সালে এ আইনের কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। এই আইনের আওতায় রাস্তায় গাড়ি চালাতে হলে এর প্রতিটি বিধান মেনে চলতেই হবে। এ আইনে উল্টো পথে গাড়ি চালানোর সাজা দুই রকমভাবে বলা আছে।

উল্টো দিকে গাড়ি চালানো কিন্তু বিপজ্জনক বা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর মধ্যেই পড়ে। তাই এ ধারার ফাঁকফোকরের যুক্তি দিয়ে লাভ নেই। এ আইন ছাড়া দন্ডবিধিতেও শাস্তির কথা উল্লেখ করা আছে। দন্ডবিধিতে শাস্তির মাত্রা কিন্তু বেশি।

দন্ডবিধির ২৭৯ ধারায় বলা হয়েছে, জনসাধারণের ব্যবহৃত কোনো সড়কের ওপর দিয়ে বেপরোয়া বা অবহেলামূলক গাড়ি চালালে তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনা শ্রম কারাদন্ড কিংবা সর্বনি¤œ এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকাসহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে হবে। উল্টো পথে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়লে পুলিশ কোন ধারায় ব্যবস্থা নেবে তা পুলিশের ব্যাপার। পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতারও করতে পারে। তবে যে ধারায় দিক না কেন, আইনের হাত থেকে মুক্তির উপায় কিন্তু সহজ নয়। জামিন জিম্মার বিষয়ও জড়িত রয়েছে এখানে। ভ্রাম্যমাণ আদালতেরও এখতিয়ার রয়েছের তাৎক্ষণিক সাজা দেওয়ার।