শনিবার বেলা দুইটা। মগবাজার ওয়্যারলেস থেকে রিকশায় পরিবাগ পর্যন্ত যেতে কয়েক ডজন মিছিল অতিক্রম করতে হলো। একটি গন্তব্যকে লক্ষ্য করে মিছিলগুলো এগুচ্ছে। এতে অংশ নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। তাদের গন্তব্য ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে; যেখানে দলমত নির্বিশেষে সারাদেশ থেকে মানুষ এসেছে। এদিন বানের স্রোতের মতো প্রতিবাদি মানুষের স্রোত ছিল ঢাকার সব রাস্তায়। সবার সম্মিলন ঘটেছে গাজায় পাখির মতো নারী-শিশুর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে। এসব মিছিলের স্লোগানে ইসরাইল, নেতানিয়াহু এবং তার দোসরদের নিন্দাবাদ জানান দিতে থাকে। পোশাকে আসাকে মিছিলের সবাই এদিন ফিলিস্তিনী সাজার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ ফিলিস্তিন রুমাল পরিহিত অবস্থায় মিছিলে অংশ নিতে দেখা গেছে।
পরিবাগে রিকশা থেকে নেমে মুল রাস্তায় ঢুকতেই দেখা গেল জনসমুদ্র। এই জনসমুদ্রের মধ্যে মিছিলের স্রোত। এই স্রোত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। মিছিলের সাথে মিশেই এগুতে থাকি। কিছু দূর গিয়ে আর মিছিল এগুতে চায় না। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে গিয়ে মিছিল রীতিমত থেমে যায়। সেখানে দাঁড়িয়েই সবাই স্লোগান দিতে থাকে তুমি কে? আমি কে? ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন। আমার ভাই মরলো কেন? ইসরাইল জবাব দে। নেতানিয়াহু জবাব দে।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সবার মাথায় গাজাকে সমর্থনের ফিতা। হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা আর নানা প্রতিবাদী পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনসহ নানা প্রতিকী চিত্রকর্ম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে গাজার শিশুর রক্তাক্ত লাশ। অনেকেই গাজার শিশুর প্রতিকী লাশ কোলে নিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছে। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে মিছিলের পাশে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তারা প্রতিবাদী মিছিলের মানুষগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। যারাই এই লাশ দেখেছে তারাই এই লাশের কাছে গিয়ে সংহতি জানিয়েছে। কেউ পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে। আবার কেউ একনজরে লাশের দিকে তাকিয়ে সমবেদনার নিরবতা পালন করেছে।
ততক্ষণে ঘড়িতে তিনটার বেশি বেজে গেছে। সোহরাওয়ার্দী ময়দানের মাইক থেকে ভেসে আসে মিজানুর রহমান আজহারীর কণ্ঠ। তিনি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। তিনি মাইকে রাজনীতিবিদদের ডেকে নিলেন স্টেজে। কিছুক্ষণ পর আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান পাঠ করলেন এদিনের ঘোষণাপত্র। তিনি ডাক দিলেন ইসরাঈলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার পক্ষে। ইসলাইলী পন্য বয়কট করার জন্য। নারী ও শিশু হত্যার প্রতিবাদে ইহুদিদের বিচারে কাঠগড়ায় তোলার জন্য।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী গণহত্যার প্রতিবাদে এদিন পুরো ঢাকার রাস্তায় শিশুর প্রতীকী লাশ নিয়ে এগিয়ে আসে। শিল্পকলা একাডেমির সামনের রাস্তায় একদল যুবকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের ভিড় মৎস্য ভবন ছাড়িয়ে শিল্পকলা একাডেমি পর্যন্ত এসে পড়ে। শিল্পকলা একাডেমির সামনের রাস্তায় দেখা যায়, একদল তরুণ ভ্যানের ওপর ঢোল বাজিয়ে ফিলিস্তিনি শিশুর প্রতীকী লাশ নিয়ে প্রতিবাদ করছেন। ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে শনিবার ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ ব্যানারে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির আয়োজিত হয়। দল-মত নির্বিশেষে এই কর্মসূচিতে লাখ লাখ মানুষ অংশ নেন।
ঢাকা হয়ে উঠে ফিলিস্তিনের প্রতিচ্ছবি। রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে, গলা ফাটিয়ে হাজার হাজার মানুষ বলছে ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’। চারপাশে শোভা পাচ্ছে লাল-সবুজ আর সাদা-কালো রঙের পতাকা। বাদ যায়নি নারীরাও। তারা পতাকা হাতে সংহতি জানিয়ে মিছিলে অংশ নেন। এদে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং আশপাশের এলাকাগুলো পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। একটাই দাবিÍ গণহত্যা বন্ধ করো, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন কর।
সমাবেশস্থলে দেখা যায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, রাজনীতিক, ইসলামি বক্তা, মানবাধিকারকর্মী এবং সংস্কৃতিকর্মীরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে স্লোগান দেন।
আয়োজক সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা।
রাজধানীর পল্টন মোড়, গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট, শিক্ষা ভবন হয়ে দোয়েল চত্বর দিয়ে এবং চানখারপুল থেকে সরাসরি দোয়েল চত্বর দিয়ে মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যায় অংশ গ্রহণকারীরা। কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাসে, পিকআপ, রিকশা, পায়ে হেঁটে এবং একজনকে ঘোড়ায় চড়েও আসতে দেখা গেছে। এছাড়া বাংলামোটর থেকে আসা মিছিল শাহবাগ হয়ে রমনা গেট দিয়ে।
কাকরাইল মোড় হয়ে আসা মিছিল মৎস্য ভবন হয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট গেট দিয়ে, বকশীবাজার মোড় দিয়ে আসা মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে টিএসসি গেট দিয়ে এবং নীলক্ষেত মোড় দিয়ে আসা মিছিল ভিসি চত্বর হয়ে টিএসসি গেট দিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশে যোগ দেয়।
এ কর্মসূচিতে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন দল, সংগঠন এবং ইসলামি বক্তা যোগ দেয়।
নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে আসা শাহিনা আল মনসুর জানান, আমি একজন ব্যবসায়ী। ফিলিস্তিনে মুসলমানদের ওপর যেভাবে গণহত্যা চালানো হচ্ছে, তা সহ্য করা যায় না। তাই প্রতিবাদ জানাতে আজ এখানে এসেছি। দলমত নির্বিশেষে নানা বয়সী মানুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নেন। শুধু ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি সংহতি জানানো নয় বরং মানবতার পক্ষেও এই অবস্থান বলে জানান অনেক অংশগ্রহণকারী।
‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে আসা নিরব আহমেদ বলেন, ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতেই পতাকা কিনলাম। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের পতাকা রয়েছে, আমি বড়টাই কিনেছি। টি-শার্ট ও মাথার ব্যাজ পরা শফিক বলেন, যেহেতু ফিলিস্তিনের জন্য আয়োজিত সমাবেশে অংশ নিচ্ছি, তাই তার অংশ হতেই টি শার্ট, ব্যাজ কেনা। যেন মনে হয় আমি নির্যাতিত ফিলিস্তিনরই একজন। আয়োজকরা জানিয়েছেন, এতে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।