* রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গ নির্বাহী আইন ও বিচার বিভাগে সংস্কার প্রয়োজন : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, কোনো দল যখন চিন্তা করে পাঁচ বছর পর ক্ষমতা হারাব, তখন ভয়ে হলেও তারা খারাপ কাজ কম করে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কম করে। কোনো দলের ক্ষমতা হারানোর ভয় চলে গেলে তারা দানবে পরিণত হয়। যেটি আমরা বিগত আওয়ামী শাসনামল দেখলে বুঝতে পারি।

গতকাল শনিবার ঢাবির মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি’ আয়োজিত ১১তম মানবাধিকার সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। সংগঠনটির চেয়ারপারসন শাহজাদা আল আমিনের সভাপতিত্বে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী মো. নুর খান, জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় (ইউএনআরসিও) বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ একরামুল হক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সাইফুদ্দিন আহমেদ বক্তব্য দেন।

সেমিনারে আওয়ামী লীগ আমলে গুম হওয়া ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম (আরমান) ও মাইকেল চাকমার পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য দেন । এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া নাইমা সুলতানার এবং আহত শাহরিয়ার খানের পরিবারও গত সরকারের সময় গুমের শিকার ব্যক্তিরা সম্মেলনে বক্তব্য দেন।

উপদেষ্টা বলেন, সবার আগে রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গ নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগে সংস্কার প্রয়োজন। এই তিনটি জায়গায় সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। অথচ এগুলো ঠিক না করে শুধু তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন বা সেমিনারের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না।

উপদেষ্টা বলেন, ক্ষমতা হারানোর ভয় কেটে গেলে একটি সরকার কীভাবে দমনমূলক ও দানবীয় রূপ নিতে পারে, তা আওয়ামী লীগের শাসনামলেই প্রমাণ হয়েছে ।

তিনি বলেন, “তখন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তবে তিনি আশাবাদের কথাও বলেন, “আমরা আশাবাদী হতে পারি, কিন্তু বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে নয়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা একটি দীর্ঘ, ধৈর্য ও সচেতনতার সংগ্রাম।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘১৯৯১ থেকে ২০১১-১২ সাল পর্যন্ত দেশে মোটামুটি ভালো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার এসেছিল। যার কারণে আমরা কিছুটা হলেও ভালোর দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১৩ সালের সময়েও অনেকগুলো মেয়র নির্বাচনে অন্য দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত স্বচ্ছতা ছিল।’

অনেকে বলেন নির্বাচন মানেই কি সবকিছু নাকি এই কথা উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি যাঁরা বলেন, তাঁদের দেখা উচিত বাংলাদেশে সেরা সময় কেটেছে ১৯৯১ থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত। কারণ, তখন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার হস্তান্তর ছিল। এটি থাকলে জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকে। তখন দেশ ভালোর দিকে এগিয়েছে। আমাদের দলগুলোর প্রত্যেকের তো সমস্যা আছে। কোনো দল যখন চিন্তা করে পাঁচ বছর পর ক্ষমতা হারাব, তখন ভয়ে হলেও তারা খারাপ কাজ কম করবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কম করে। কোনো দলের ক্ষমতা হারানোর ভয় চলে গেলে তারা দানবে পরিণত হয়। যেটা আমরা বিগত আওয়ামী শাসনামলে দেখলে বুঝতে পারি। যার কারণে এক হাজারের বেশি ছাত্রজনতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু হয়ে যেতে হয়েছে। কত কঠিন ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে।’

মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান বলেন, জুলাই ও আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে এক বছর হতে চলেছে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আগের ফ্যাসিস্ট যেই কাজগুলো করেছে, সেই কাজগুলো যাতে আমরা না করি। ভেবে দেখেন এক বছর আগে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বললে কী পরিণতি হতো। ...স্বৈরাচারের চেয়েও বড় স্বৈরাচারের দিকে যাচ্ছে দেশ। এটি যদি এখনই না থামিয়ে দেওয়া যায়। পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে কিন্তু ধ্বংস করে দেবে। স্বৈরাচার কিন্তু শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে না। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরেও স্বৈরাচার মনস্তাত্ত্বিক জায়গায় থাকে। সেটিকেও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।’

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘আমাদের সামনে দুইটা বড় এবং কঠিন দায়িত্ব এই মুহূর্তে। এক হলো জুলাই এবং তার আগে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, তার বিচার করতে হবে। এসব পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু ক্ষতিপূরণ দিলে হবে না, তাদের জীবনটা আসলে কীভাবে মেরামত করা সম্ভব, সেটির চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি কেন এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলো? আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা যাদের কাজ, তারা কেন উল্টো দিকে চলে গেল। সেটির কারণও খুঁজে বের করতে হবে।’

সম্মেলনে অংশ নেন গুম ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও। ২০১৯ সালে গুম হওয়া অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা বলেন, “আমার পরিবারের লোকজন আমার খোঁজ করতে করতে একসময় ধরে নিয়েছিল, আমি আর বেঁচে নেই। তারা আমার শেষকৃত্যও করে ফেলেছিল। একজন মানুষ কতটা আশাহীন হলে এমন সিদ্ধান্ত নেয়, তা ভাবা যায়?”

তিনি আরও বলেন,আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় আমাদের ভবিষ্যৎ কী? গুম কি বন্ধ হবে? আর কত পরিবার এই দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াবে?”