সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ৬ অক্টোবর গণশুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। রাজধানীর বিয়াম অডিটরিয়াম ওই গণশুনানি গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেছেন, আগামী ৬ অক্টোবর গণশুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পেট্রোবাংলা সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার আবেদন করে। এতে সারের উৎপাদন খরচ কত বৃদ্ধি পাবে, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কি হবে। সে বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি প্রস্তাবে।

পেট্রোবাংলা বলেছেন, দাম বাড়ানো হলে ৬ মাস (অক্টোবর-মার্চ) পুরোমাত্রায় (২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হবে। অবশিষ্ট ৬ মাসের মধ্যে এপ্রিল-মে ১৬৫ মিলিয়ন হারে, জুনে ১৭৫ মিলিয়ন এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৩০ মিলিয়ন হারে গ্যাস সরবরাহ দেবে। বর্তমানে সার উৎপাদনে দৈনিক ৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে।

২০২৫ সালে ১০৮ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। দাম বাড়ানো হলে আরও ৭ কার্গো এলএনজি আমদানি করে সারে সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলেছে পেট্রোবাংলা। দেশে ৬টি সার কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আশুগঞ্জ সার কারখানা অনেক পুরনো হওয়ায় গ্যাস খরচ অনেক বেশি, যে কারণে কারখানাটি বন্ধ রাখা হয়েছে। অপর ৫টি সার কারখানায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১১৫ কার্গো এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হবে ৫৫ হাজার ৩২ কোটি ৩০ লাখ টাকা, দাম বাড়ানো হলে আয় হবে ৪৪ হাজার ৩৪২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। দাম বাড়ানোর পরও ঘাটতি থাকবে ৮৩৫৫ কোটি টাকা। সরকার কর্তৃক ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বিবেচনায় নিলে ঘাটতি থাকবে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ঘনমিটার প্রতি গ্যাসের মিশ্রিত ব্যয় ২৮.৭৮ টাকা আর গড় বিক্রয়মূল্য দাঁড়াবে ২৪.৫৬ টাকা। এখানে ঘাটতি থাকবে ৪.২২ টাকার মতো।

পেট্রোবাংলা প্রক্কলন অনুযায়ী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১১৫ কার্গো এলএনজি আমদানি করলে দৈনিকি গড়ে ৯৩২ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি হবে। যার জন্য খরচ হবে ৫৭ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। আর আমদানির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে, এতে খরচ পড়বে ৫ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান বলেছেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন। বাড়তি টাকা দিয়ে আরও বেশি এলএনজি আমদানি করে সার উৎপাদনে দেওয়া হবে। তাতে করে গ্যাস অভাবে বন্ধ ৪টি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হবে।

পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ার কারণে সব শ্রেণিতে প্রভাব পড়েছে, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সার। ঘাটতি থাকায় তিনটি সময়ে রেশনিং করে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে গ্যাস দেওয়া হয়। গড়ে দৈনিক ১১৬ মিলিয়ন (চহিদা ২৫০ মিলিয়ন) গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়। গ্যাস অভাবে বিপুল ব্যয়ে স্থাপিত সারকারখানাগুলো বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকছে। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদনের চেয়ে আমদানি ব্যয় অনেক বেশি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআরসি) চেয়ারম্যান মোঃ ফজলুর রহমান বলেছেন, একটি কমিটি কাজ করছে, সেখানে শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিনিধিরা রয়েছে। তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন, দাম বাড়লে যে ট্রেড গ্যাপ হবে সেই টাকা সরকার দেবে। এখন ৩৮ টাকার মতো খরচ পড়ে আমরা ২৫ টাকা দরে বিক্রি করি, সরকার ১৩ টাকা হারে ভর্তুকি দিচ্ছে। তবে ৪০ টাকা হয়তো হবে না।

সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলা কয়েকটি উৎস থেকে গ্যাস কিনে থাকে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কেম্পানি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানিকে প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম দেওয়া হয় ২৮ টাকার মতো, আর বাপেক্সকে দেওয়া হয় ১১২ টাকার মতো। দেশের খনি থেকে গ্যাস উত্তোলন করা বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম দেওয়া হয় ২.৭৬ ডলার, আর টাল্লোকে দেওয়া হয় ২.৩১ ডলার। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম ১০.৬৬ ডলার ও ওমান থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছে ১০.০৯ ডলার।

সূত্র মতে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কয়েক দশকের স্থবিরতার কারণে আমদানির দিকে যেতে হয়েছে। উচ্চমূল্যের পাশাপাশি অবকাঠামো না থাকায় ইচ্ছা করলেই এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সুযোগ নেই। অন্যদিকে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন প্রতিদিনেই কমে আসছে। এক সময় দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেলেও ১৩ সেপ্টেম্বর উৎপাদন ১৭৮৩ মিলিয়নে নেমে এসেছে। অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিত আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। সারে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর যে সরল অংক দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে একমত হতে পারছেন না অনেকেই।