বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়ার্চের সেমিনারে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নির্বাচনের আগে আগামী ৬ মাসে কোন কোন সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে তা স্পষ্ট নয়। শুধু একটি দলিলে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করল, আর সংস্কার হয়ে গেল– বিষয়টি এমন নয়।

তারা বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫৪ বছরে কোনো গ্রহণেযাগ্য সংস্কার প্রক্রিয়া দেখা যায়নি। সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, দলিল লিপিবদ্ধ হয় এবং বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য ও সুনিদির্ষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয় না।

গতকাল সোমবার গুলশানের একটি হোটেলে বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ নামে একটি নতুন উদ্যোগের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

সিপিডির ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, সরকার সংস্কারের বড় তালিকা করেছে। সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। এগুলোর মধ্যে কোনটি নির্বাহী আদেশ জারি করে বাস্তবায়ন শুরু হবে এবং কোনটি আগামী সংসদে আইনের মাধ্যমে পাস হবে, তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ঘোষণা মানেই সংস্কার নয়।

তিনি বলেন, অংশীজন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা, মানুষের চাহিদা অনুধাবন, রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকারে থাকা, সংসদীয় কমিটির বিস্তারিত আলোচনা, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পুরো প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের চর্চা দেখা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন ।

রেহমান সোবহান বলেন, ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকার সময় তিনি দেশের ২৫০ জন মেধাবী ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও একটি টাস্কফোর্সের প্রধান ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারগুলো এসব টাস্কফোর্সের প্রস্তাব আমলে নেয়নি।

রেহমান সোবহান বলেছেন, নির্বাচনের আগে আগামী ৬ মাসে কোন কোন সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে– তা স্পষ্ট নয়। শুধু একটি দলিলে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করল, আর সংস্কার হয়ে গেল– বিষয়টি এমন নয়।

নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, যেসব সংস্কার প্রস্তাব এসেছিল, সেগুলো মাঝে যেন আর এগোতে পারল না। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার কি পথ হারিয়েছে, এই প্রশ্নটি এখন সবার মধ্যে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে একটা বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যে বৈষম্যবিরোধী চেতনা পেয়েছি, এটা বাংলাদেশের বড় সম্পদÍযেটিকে এই ঝড় থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যে উচ্ছ্বাস নিয়ে সরকার ও সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, সে উচ্ছ্বাস ও উৎসাহ এখন কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেছে। আমরা দেখেছি, সংস্কার প্রক্রিয়ায় যেসব কমিটি হলো, সেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন পর্যায়ের অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল না।এই সময়কালে শিখেছি, সংস্কারের জন্য কারিগরি সমাধান অনেকেই দিতে পারে, তবে সেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য দরকার জবাবদিহিতামূলক নাগরিক চাহিদা,’ বলেন দেবপ্রিয়।

আলোচনায় নাগরিক প্লাটফর্মের কোর গ্রুপ মেম্বার ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘১৯৯১ সালেৃ২৯টা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। তখন অনেক সংস্কার প্রস্তাব এলেও সেগুলোর সব বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে অনেক ধাক্কার পর জুলাই অভ্যুত্থান আমরা দেখেছি। তাই বর্তমানে আমাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সংস্কার আলোচনা ও ওয়াচ জারি রাখতে হবে।’

অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, ‘সংস্কারবিরোধী শক্তিগুলো সরকার ও সমাজের মধ্যে রয়ে গেছেন। ফলে সংস্কার করার মতো রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বদলেছে কি না বা অঙ্গীকারবদ্ধ কি না, এটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ নির্বাচন ও এর পরেও রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহি করতে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করি।’

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবার প্রত্যাশা ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এক বছরে সেই সংস্কার কার্যক্রম কত দূর এগোল? জুলাইয়ের পর আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করেছি। তার ধারাবাহিকতায় আজকের এই রিফর্ম মঞ্চের যাত্রা শুরু। অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।