অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশসহ আরও বেশ করেয়েকটি দেশের শুল্কের পরিমাণ ঘোষণা করেছে ওয়াশিংটন। গতকাল শুক্রবার শুল্ক নিয়ে হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় নতুন এই শুল্কহারের তথ্য দেওয়া হয়েছে। পহেলা আগস্ট থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর শুরু হয়েছে। শুল্ক হার কমানোর ঘটনাকে সরকারের কূটনৈতিক বিজয়ের মাইলফলক হিসেব দেখেছেন রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল। শুল্কহার কমানোর কারণে অভিনন্দন জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এছাড়া ব্যবসায়ী মহলে নেমে এসেছে স্বস্তি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এর মাধ্যমে কয়েক ডজন দেশ ও বিদেশী অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত নতুন পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই আদেশ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
এছাড়া অন্যান্য দেশের মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ, ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ওপর ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ শতাংশ ও ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং নতুন এই শুল্কহারের কথা জানিয়ে এক প্রেস বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু মার্কিন রপ্তানির ওপর শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না, বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্য ঘাটতি ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগ সমাধানে একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরেও নির্ভর করছিল।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ২০ শুল্ক পেয়েছেÍযা তৈরি পোশাক খাতের প্রধান প্রতিযোগী দেশ শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার প্রায় সমান। এই দেশগুলো ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে শুল্ক পেয়েছে। ফলে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের তুলনামূলক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বিত চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারায় ভারতের ওপর ২৫ শতানংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
শুল্ক আলোচনায় নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা সতর্কতার সাথে আলোচনা করেছি, যাতে আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করা ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তবে এর পাশাপাশি আমরা মার্কিন কৃষিপণ্য কেনার বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সঙ্গে আমাদের সদ্ভাব বাড়াবে।’
তিনি আরও বলেন, আমরা সফলভাবে একটি সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়াতে পেরেছি। এটি আমাদের পোশাক খাত এবং এর ওপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য সুখবর। এর মাধ্যমে আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছি এবং বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।’
গত ২ এপ্রিল বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির কথা বলে বিভিন্ন দেশের ওপর চড়া শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। সে সম বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। পরে দেশগুলোকে শুল্ক নিয়ে আলোচনার সুযোগ দিতে ৯ এপ্রিল ওই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। ৯ জুলাই সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়। ৯ জুলাইয়ের পর শুল্কহার কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত দেশগুলোকে সময় বেঁধে দেয় ওয়াশিংটন।
ওই সময়সীমা শেষে গতকাল থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর শুরু হয়ে। নতুন ২০ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ মিলিয়ে মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। এ হিসাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৬১৫ কোটি ডলারের।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা যদি শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে বিষয়গুলো অনেক সহজ হতো। কিন্তু দরকষাকষি শুধু শুল্ক নিয়ে নয়, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তিতে থাকা বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতাবিষয়ক শর্ত, যা পুরো বিষয়টির জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাধ্যবাধকতা আবার অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার বাইরে। এমনকি সেগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সূত্র আরো জানায়, দরকষাকষির আলোচনাটি শুল্কের চেয়েও বেশি বাণিজ্য বিধিমালাবিষয়ক। এমনকি সেগুলো শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিকও না। অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও খাতসংশ্লিষ্টদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয় রয়েছে। বাণিজ্যবিষয়ক কিছু শর্ত একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত বাংলাদেশের পক্ষে মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব।
এদিকে, এপ্রিলে ট্রাম্প টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, তিনি দুই শতাধিক চুক্তি করছেন। কিন্তু বাস্তবে ১২০ দিনে মাত্র ১১টি চুক্তি হয়েছে, যার মধ্যে একটি পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে।
২ জুলাই ট্রাম্পের ঘোষণায় ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক ৪৬% থেকে কমিয়ে ২০% করা হয়েছে। তবে পলিটিকো জানিয়েছে, ভিয়েতনাম মাত্র ১১% প্রত্যাশা করেছিল। ট্রাম্প একতরফাভাবে ২০% ঘোষণা করেন। ট্রান্সশিপমেন্টের ৪০% শুল্ক কীভাবে কার্যকর হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
ইন্দোনেশিয়ার জন্য পাল্টা শুল্ক ৩২ থেকে ১৯ শতাংশে হ্রাস করা হয়েছে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৯% পণ্যে শুল্ক বিলোপ ও নন-ট্যারিফ বাধা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাকার্তা।
২৩ জুলাই চুক্তির আওতায় জাপানের ওপর শুল্ক ২৫% থেকে ১৫% করা হয়েছে। গাড়ি উৎপাদন খাতে বিশেষ ছাড় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প বলেছেন, জাপান ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে যুক্তরাষ্ট্রে, যার ৯০% মুনাফা পাবে আমেরিকানরা।
চীনের সঙ্গে এখনো চুক্তি হয়নি, আছে কেবল মে মাস থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত একটি সাময়িক বিরতি। এখন চীনের ওপর ৩০% ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১০% শুল্ক বলবৎ। সর্বশেষ স্টকহোম বৈঠকে কোনো নতুন চুক্তি হয়নি।
বুধবার ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ভারতের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে অস্ত্র ও জ্বালানি কেনার জন্য একটি অতিরিক্ত ‘পেনাল্টি’ও থাকবে। আগে এ হার ছিল ২৬%। ট্রাম্প বলেন, ‘ভারতের শুল্কহার বিশ্বের সর্বোচ্চের মধ্যে একটি।’
এদিকে শুল্ক থেকে বাঁচতে মেক্সিকোকে আরো ৯০ দিনের সময় দিয়েছেন ট্রাম্প। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শেনবাউমের সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর ট্রাম্প বলেন, ‘আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে আগের বাণিজ্য চুক্তিটি আরো ৯০ দিনের জন্য বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মেক্সিকোর সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি অন্য অনেক দেশ থেকে আলাদা, কারণ আমাদের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে, যেখানে অনেক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, মেক্সিকো আগামী ৯০ দিন আগের মতোই যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতনির ক্ষেত্রে নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করবে। এর মধ্যে রয়েছে ফেন্টানিলে ২৫ শতাংশ, গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ এবং স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও কপারের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক।
‘ফারদার মডিফায়িং দ্য রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ রেটস’ শিরোনামে জারি করা আদেশে ৬৯টি বাণিজ্যিক অংশীদার দেশের তালিকা ও সংশ্লিষ্ট শুল্কহার প্রকাশ করেছে হোয়াইট হাউস। ওই তালিকা অনুযায়ী কোন দেশে কত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০%,আফগানিস্তান ১৫%,আলজেরিয়া ৩০%,অ্যাঙ্গোলা ১৫%,বলিভিয়া ১৫%,বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ৩০%,বতসোয়ানা ১৫%,ব্রাজিল ১০%,ব্রুনেই ২০%,কম্বোডিয়া ১৯%,ক্যামেরুন ১৫%, চাদ ১৫%,কোস্টারিকা ১৫%,কোট দিভোয়ার (আইভরি কোস্ট) ১৫%,কঙ্গো গণপ্রজাতন্ত্রী ১৫%,ইকুয়েডর ১৫%,ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ১৫%,ভারত ২৫%,ইন্দোনেশিয়া ১৯%,ইরাক ৩৫%,ইসরায়েল ১৫%,জাপান ১৫%,জর্ডান ১৫%,কাজাখস্তান ২৫%,লাওস ৪০%,ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ১০%,ফিজি ১৫%,ঘানা ১৫%,গায়ানা ১৫%,আইসল্যান্ড ১৫%,লেসোথো ১৫%,লিবিয়া ৩০%,লিচটেনস্টেইন ১৫%,মাদাগাস্কার ১৫%,মালাউই ১৫%,মালয়েশিয়া ১৯%,মরিশাস ১৫%,মলদোভা ২৫%,তিউনিসিয়া ২৫%,তুরস্ক ১৫%,উগান্ডা ১৫%,যুক্তরাজ্য ১০%।
শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে টানা তিন দিন আলোচনা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। গত মঙ্গল ও বুধবারের পর গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা করা হয়। এ আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। প্রতিনিধি দলে আরো আছেন প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী। দুদিনের বৈঠকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কর্মকর্তারা ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়েছেন।