বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, জুলাই আন্দোলনের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যাশায় জাতি পুরাতনকে বিতাড়িত করেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে নতুন-নতুন ইস্যু আসবেই। যারা নতুন নতুন ইস্যুতে অস্বস্তিবোধ করে, তারা মূলত নতুন বাংলাদেশ চায় না। তারা আওয়ামী জাহেলিয়া নতুনরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাষ্ট্র কাঠামোর যেখানে সংস্কার প্রয়োজন, সেখানেই একটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। মুখে স্বীকৃতি দিলেই সংস্কার হয়ে যাবে না, সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত বিষয়ে একমত হওয়া, তারপর সেই আলোকে আইন তৈরি করা এবং আইনের বাস্তবতা দেওয়া হলেই সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে বলা যাবে। এজন্য জামায়াতে ইসলামী বারবার জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। জামায়াতে ইসলামীর দাবি গণমানুষের দাবি। যার ফলে দেশের ছোট-বড় প্রায় সব দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবানের দাবি জানিয়ে আসছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম হলরুমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ আয়োজিত "জুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান ও বাস্তবায়ন এবং পিআর পদ্ধতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে"- আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের ঘোষণা ছিল প্রধান উপদেষ্টার। অথচ প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান রূপ না দিয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি যেই রোডম্যাপ দিয়েছেন, সেই রোডম্যাপেই নির্বাচন হতে পারে। এতে জামায়াতে ইসলামীর কোন আপত্তি নাই। তবে অবশ্যই নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই আলোকে গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করতে হবে। তারপর পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিয়ে জনগণের সংসদ ও সরকার গঠন করতে হবে। দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতিতে ভোট চায়। একটি মাত্র দল ব্যতীত অন্য সব দলও পিআর পদ্ধতিতে ভোট চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনভাবেই দেশের ৭১ শতাংশ জনগনকে এবং ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলকে উপেক্ষা করে একটি মাত্র দলের জন্য পিআর পদ্ধতি এড়িয়ে যেতে পারে না, পারবে না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক সমঝোতায় পিআর পদ্ধতি এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে না পারলে ‘পিআর পদ্ধতি এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণভোট দিতে হবে’। যারা পিআর বুঝে না দাবি করে, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার জ্ঞানও নেই। আসলে পিআর পদ্ধতি তারাও বুঝে কিন্তু মেনে নিতে চায় না। কারণ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে, অস্ত্রবাজী-কেন্দ্র দখল করতে পারবে না বিধায় তারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় না। ভয় আর হতাশায় তারা পিআর মেনে নিতে পারছে না। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ইতিহাসে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কেউ নির্বাচনে কারচুপি করতে পারবে না। পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হবে। তাই জাতির প্রত্যাশিত নতুন বাংলাদেশ গড়তে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে পিআর পদ্ধতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে জনগণ দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে আসবে। বাংলাদেশের মানুষ জানে কিভাবে দাবি আদায় করতে হয়। সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান হবার আগে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। পরিকল্পিত নির্বাচন হলে সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পৌঁছাতে দেবে না। তিনি সরকারি আমলাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কোনো কোনো আমলা ধরেই নিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে বোধহয় নির্দিষ্ট একটি দল ক্ষমতায় বসে যাবে। সেজন্য কিছু আমলা নির্বাচনের আগেই এদিক-সেদিকে ঝোঁক দিতে দেখা যাচ্ছে। তিনি আমলাদের নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জনগণ ঘুমিয়ে নেই। জনগণ সব রাজনৈতিক দলকেই পর্যবেক্ষণ করছে। পাথর দিয়ে মানুষ হত্যা করে, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী করে কেউ ক্ষমতায় বসতে পারবে না। পাথর যত পরবে, ভোটের পারসেন্ট ততই কমবে। এজন্যই তারা সংস্কার ও বিচারের দাবি না জানিয়ে শুধু নির্বাচন নির্বাচন জিকির করতে শুরু করেছে। নির্বাচন নিশ্চয়ই হবে তবে আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে সংস্কার ও গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর মো. নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা জেনারেল আব্দুল হালিম বলেন, জুলাই ঘোষণায় শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীর সমাবেশে আওয়ামী লীগের পরিচালিত গণহত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়নি। চব্বিশের ০৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ডামি নির্বাচন পরবর্তী ৬ মাস পেরিয়ে গেলে যেই দল নির্বাচনের দাবিতে একটা মিছিল পর্যন্ত করেনি, করতে পারেনি; সেই দল ছাত্র-জনতার বিপ্লব পরবর্তী সারাক্ষণ নির্বাচন নির্বাচন করছে। অথচ তারা গণহত্যার বিচার কিংবা রাষ্ট্রের সংস্কার এমনকি জুলাই যোদ্ধাদের অবদানের জন্য জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতেও দাবি জানাচ্ছি। উল্টো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেছে। তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমান গণভোট দিয়ে নিজের ক্ষমতার বৈধতা দিতে পারলে, জনগণের দাবির যথার্থতা যাচাইয়ে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে জনমত সংগ্রহে গণভোটে তাদের আপত্তি কেন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারীতে একতরফা নির্বাচন করার কথা জাতি ভুলে যায়নি। কার হাতে, কার দ্বারা, কখন, কীভাবে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে জাতি সেগুলো জানে। জামায়াতে ইসলামী 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' ব্যবস্থা উত্থাপিত করার পর যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরোধিতা করে বলেছিল, পাগল আর শিশু ব্যতীত কেউ নিরপেক্ষ নয়, তারা পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহালের দাবিতে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এমনকি এখানো আইনি লড়াই চালাচ্ছে। আজকে যারা পিআর বুঝে না দাবি করছে, তারা অচিরেই পিআরের দাবিতে ঐক্যমত পোষণ করবে। কারণ তারাও বিশ্বাস করে, জামায়াতে ইসলামীর উত্থাপিত সকল ফর্মুলা দেশ ও জাতির স্বার্থে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলাওয়ার হোসেনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা-১৩ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, ঢাকা-১০ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর, ঢাকা-৮ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি, ঢাকা-৫ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মোহাম্মদ কামাল হোসেন, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, ঢাকা-৯ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী কবির আহমেদ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য, ঢাকা-৪ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন প্রমুখ।

সভাপতির বক্তব্যে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, জুলাই সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর যেই দায়িত্ব দিতে চায়, এটি হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটি হবে জুলাই যোদ্ধাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। যদি নির্বাচিত সরকারই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হয়, তাহলে জাতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বড় দল দাবি করা দল গণভোটকে ভয় পায় কেন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, কারণ তারা জনগণের পক্ষে কথা বলে না, কাজ করে না। তাদের কথা ও কাজ শুধুমাত্র নিজেদের দলীয় স্বার্থে। কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তিকে জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না হুশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, দেশের ৭১ শতাংশ জনগণ পিআর চায়। অথচ একটি দল কথায় কথায় বলে পিআর পদ্ধতি জনগণ বুঝে না। আসলে জনগণের সঙ্গে ঐ দলের কোন যোগাযোগ বা সম্পর্কই নাই। সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ায় তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি কোন সংবিধানের ক্ষমতা বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন। জাতির সামনে সেটিও স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়ে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, কোনো একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করা পরিহার করুন। নয়তো রকিব-হুদার কমিশনের পরিণতি আপনাদেরকেও ভোগ করতে হবে। প্রেস বিজ্ঞপ্তি।