চব্বিশের জুলাই-আগষ্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে সারাদেশে পুলিশ নানা কায়দায় দমন-পীড়নের পাশাপাশি নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে অগণিত নারীশিশুসহ নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষকে হতাহত করে। দীর্ঘদিনের সরকারী লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া পুলিশের ভাবমর্যাদার ওপর কলংক তিলক লেগে যায় এরকটা সময়ে এসে। আওয়ামীলীগের সময়ে সরকার বিরোধীদের থামাতে বাহিনীটি পেশাদারত্ব ছেড়ে ঠেঙ্গারে বাহিনীতে পরিণত হয়। তার ওপর গণআন্দোলনের বিতর্কিক ভূমিকায় গোটা পুলিশ বাহিনীর সাথে দেশের আপামর জনতার বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় পুলিশ পড়ে যায় বেকায়দায়। জনগণের সঙ্গে সৃষ্ট পুলিশের বড় ধরনের দুরত্ব’র খবর প্রকাশ পায়। এই দুরত্ব ঘোচাতে সারাদেশে ‘ওপেন হাউস ডে’ বা উন্মুক্ত দিবসের আলোচনা সভা শুরু করেছে পুলিশ। এই ‘ওপেন হাউস ডে’ আলোচনা সভা শুরু করতে গত ২৮ জুলাই পুলিশ সদর দপ্তর সকল রেঞ্জ ডিআইজি, মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং সব জেলার পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছিল। সেবা গ্রহণে নাগরিকদের সমস্যা, অভিযোগ-অনুযোগ শোনার জন্য সকল সরকারি দপ্তরে নির্দিষ্ট বিরতিতে গণ শুনানি নিশ্চিত করতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছিল। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নে আবার ওপেন হাউস ডে শুরু করেছে পুলিশ বিভাগ।

পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছেন, গত বছর জুলাই-আগষ্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে জনগণের সঙ্গে পুলিশের মারাত্মক দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দুরত্ব কমিয়ে আনতে এলাকাভিত্তিক ‘ওপেন হাউস ডে’ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকের অপব্যবহারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কাজ সহজ হবে। এছাড়া বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নেও এই উদ্যোগ ভূমিকা রাখবে বলে তারা মনে করেন।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০০৭ সালে তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার নাইম আহমেদ রাজধানীর থানাগুলোয় ‘ওপেন হাউস ডে’ কর্মসূচি চালু করেন। তার সেই উদ্যোগ ভালো ফল দেওয়ায় সারা দেশে তা চালু করে পুলিশ সদর দপ্তর। তখন এই কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য ছিল, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এলাকার জনগণের সঙ্গে পুলিশের এক হয়ে কাজ করা। ওপেন হাউস ডে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থানা এলাকাবাসী প্রকাশ্যে নিজ নিজ এলাকার আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ পরিস্থিতির বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য তুলে ধরতেন। মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ দিতেন পুলিশের কাছে। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্থানীয় থানা পুলিশ পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। এতে জনগণের সঙ্গে পুলিশের একটি সম্পর্ক তৈরি হতো। এই সম্পর্কের কারণে এলাকার যেকোন ঘটনার খবর পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যেতো। এতে পুলিশ তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা নিয়ে যেকোন অপরাধের ঘটনা বড় হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতো।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওপেন হাউস ডে অনুষ্ঠানে মেট্রোপলিটন এলাকায় ডেপুটি পুলিশ কমিশনার/অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার/সহকারী পুলিশ কমিশনার উপস্থিত হন। আর জেলাগুলোতে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত অংশ নেন। এই অনুষ্ঠানে খোলামেলা আলোচনা করে থাকেন এলাকাবাসী। ফলে তাদের কাছ থেকে থানা পুলিশের সেবা বিষয়ে সরাসরি ধারণা লাভ করেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) মো. রবিউল হাসান গতকাল বুধবার বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে আমরা ওপেন হাউস ডে সভা শুরু করেছি। এর মাধ্যমে আমরা পুলিশ ও জনগণের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে চাই। আমরা একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চাই। জনগণের সহযোগিতা পেলে সামাজিক অপরাধ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। জনগণের কাছ থেকে আমরা নানা তথ্য পেতে পারি। এজন্য এলাকাভিত্তিক নাগরিক কমিটি গঠন করে দেওয়া হচ্ছে।

যোগাযোগ করা হলে চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার ওসি মো: আজিজুল ইসলাম গতকাল বুধবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, পুলিশ সুপারের নির্দেশনা পেয়েই আমরা মঙ্গলবার থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে ওপেন হাউজ ডে সভা করেছি। এতে কচুয়ার সকল পেশাজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা অংশ নেন, তাদের মতামত প্রদান করেন। এই সভায় কচুয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) আব্দুল হাই চৌধুরী উপস্থিত থেকে অংশীজনদের নানা আলোচনা, সমালোচনা ও পরামর্শ শুনেছেন। তিনি বলেন, আমরা জনগণের চাহিদা অনুযায়ী আইনী সেবা প্রদানে তৎপর আছি।

জানা গেছে, এক সময় ওপেন হাউস ডে সভা আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতো। তখন এই সভাতে সাধারণত সমাজের অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রধান্য থাকতো। কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে এই সভায় ক্ষমতাসীন দেলর নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। ফলে ওপেন হাউস ডে সভা তার লক্ষ্য হারাতে শুরু করে। গত বছরের ৫ আগষ্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর এই সভা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব¡ কমাতে এ বছরের পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে নাগরিকদের সঙ্গে সারাদেশে সভা করার প্রস্তাব উঠে আসে। এরপর সারাদেশে নাগরিক সভা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর গত ২৮ জুলাই সারাদেশে আবার ওপেন হাউস ডে সভা করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এরপরই সারাদেশে এই সভা শুরু হয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যান ও গবেষনা ইনস্টিটিউটের সহযোগি অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কিংবা এর পূর্বে পুলিশের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে জনগণের দূরত্ব প্রশমিত করার জন্য পুলিশের উন্মুক্ত দিবসের আলোচনা কর্মসূচি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে পুলিশের কাছে জনগণের প্রত্যাশা, পুলিশ সংস্কারের ধরন এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ও তৎপরতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতামত শোনার ও গ্রহণের সুযোগ থাকবে। যা পুলিশের সাথে জনগণের সম্পর্কগত দূরত্ব কিংবা অনাস্থার পরিধি অনেকাংশে সহনশীল অবস্থায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে।