সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যহার করে ৬০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে জয়ের বিরুদ্ধে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে সন্দেহজনক লেনদেন, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ এনেছে দুদক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের সহকারী পরিচালক এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর বাদী হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি দায়ের করেন বলে সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানিয়েছেন।
২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়কালে জয় এই অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করেছেন বলে দুদক দাবি করছে।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার সাবেক উপদেষ্টা জয় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র্র প্রবাসী।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, জয় তার সরকারি দায়িত্ব ব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে মোট ৬০ কোটি ৮৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭০ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জন করেছেন, যা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই অর্থের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বাড়ি কেনায় ও বিনিয়োগে ব্যয় করা হয়েছে ৫৪ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার ২৯৮ টাকা।
দুদক বলছে, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, আইন অনুযায়ী আয়ের উৎসের সব তথ্য আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক হলেও তিনি তা করেননি এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, জয় নিজের নামে দুটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ২২ হাজার ৯৭ টাকা লেনদেন করেছেন। তার ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেনের পরিমাণ মোট ৯৭ কোটি ৫০ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৫ টাকা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
অনুসন্ধানের বরাতে দুদক বলেছে, জয়ের নামে মোট ৫৪ কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৯৭৮ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ ও ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯১ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। তার মোট ব্যয়ের পরিমাণ ২৮ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪৩ টাকা। সব মিলিয়ে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬১ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার ৫১২ টাকা। যদিও তার আয়কর রিটার্নে প্রদর্শিত আয় ছিল ১ কোটি ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮১ টাকা।
তদন্তের বরাতে দুদক বলেছে, জয়ের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ তার জ্ঞাত আয়ের সাথে ‘অসঙ্গতিপূর্ণ’।
এজাহারে বলা হয়েছে, জয় ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে’ যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বাড়ি কিনেছেন এবং বিনিয়োগ করেছেন। তিনি দেশের আয়কর রিটার্নে তা ‘দেখাননি’ এবং দেশ থেকে বিদেশে অর্থ ‘পাচার’ করেছেন।
এছাড়া, দুদক বলেছে, তদন্তের পর যদি আরও কোনো অবৈধ সম্পদ বা এই সম্পদ অর্জনে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার স্থান হিসেবে ঢাকা ও অন্যান্য স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে ‘অনিয়ম-দুর্নীতির’ অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। তাদের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা করে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদক গত ডিসেম্বরে অনুসন্ধান শুরু করে। এরপর ১২ জানুয়ারি প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও নিয়মের’ অভিযোগে পুতুলের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। এরপর একে একে আরও পাঁচটি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও আসামি। টিউলিপ যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতিমন্ত্রী, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তিনি পদত্যাগ করেন। এই ছয় মামলাতেই শেখ হাসিনাকে আসামি করেছে দুদক। অন্যদেরও কেউ কেউ একাধিক মামলার আসামি। সব মিলিয়ে ছয় মামলার আসামির সংখ্যা ২৩।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ৬ প্লট দুর্নীতির মামলায় গত ৩১ জুলাই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে তাদের সন্তানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ঢাকার দুই বিশেষ জজ আদালত। এর মধ্যে তিন মামলায় শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ১১ অগাস্ট।
ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের ১২৪টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৬৩৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা অবরুদ্ধ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।