জনবল সংকটে ধুঁকছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নুতন জনবল নিয়োগের জন্য গত ৮ বছর ধরে চলছে চিঠি চালাচালি। বর্তমান সরকারের সময়ে দ্বিতীয় দফায় প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে অর্গানোগ্রাম। অনুমোদনের জন্য ফের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সংশোধিত জনবল কাঠামো।

সূত্র জানায়, আট বছর ধরে চলছে চিঠি চালাচালি, যে কারণে জনবল সংকটে ধুঁকছে কমিশন। এ নিয়ে আগের দফায় অনুমোদন না দিয়ে পদসৃজনের প্রাসঙ্গিকতা চেয়ে ফেরৎ দেওয়া হয়। বিগত সরকারের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। তখনও অনুমোদন না দিয়ে যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা চেয়ে ফেরৎ দেওয়া হয়েছিল।

বিইআরসি ২৮১ পদ সৃজনের প্রস্তাব করলেও (বিদ্যমান ৮১ ও প্রস্তাবিত ৬৫ পদ) ১৪৬ জনবল অনুমোদন দিয়েছে সচিব কমিটি। যে কারণে ২০০৩ সালে গঠিত বিইআরসি ৮১ জনবল নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে।

বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ জানান , লোকবল অভাবে যথাযথ আইনী দায়িত্ব পালন করা যাচ্ছে না। জনবল কাঠামো যখন তৈরি করা হয়, তারপর অনেক পরিবর্তন এসেছে। তখন যানবাহনে এলপি গ্যাস ব্যবহারের ধারণা ছিল না, এখন গ্রামে গ্রামে এলপিজি ফিলিং স্টেশন, আগে ক্যাপটিভ বিদ্যুতের ধারণাও ছিলনা। এখন ক্যাপটিভ বিদ্যুতের লাইসেন্স রয়েছে প্রায় ৫ হাজারের মতো। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আমাদের ভিজিট করা দরকার। কিন্তু লোকবল অভাবে করা যাচ্ছে না। এনার্জি অডিটিং নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, বিইআরসিকে কার্যকর করা গেলে জ্বালানি খাতের অর্ধেক সংস্কার হয়ে যাবে। আইন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দেওয়া গেলে অনেক দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। ভারতসহ অনেক দেশে কোন চুক্তি করতে হলে রেগুলেটরি কমিশনের অনুমোদন নিতে হয়। আমাদের দেশেও যদি করা যায়, তাহলে তারা দেখবে সেটির আদৌ প্রয়োজন কি না, আবার দর যৌক্তিক কি না? দেশের স্বার্থ থাকলে তারা অনুমোদন দেবে। এতে ম্যাক্রো লেভেলে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

বিইআরসি সূত্র জানায় ,জনবল কাঠামো ঝুলে থাকায় বিইআরসিতে এক ধরণের স্থবিরতা ও অসন্তোষ রয়েছে। পদ না থাকায় একই পদে বছরের পর বছর পড়ে থাকায় অনেকের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আইন অনুযায়ী সহকারী পরিচালক পদে ১০ বছর কাজ করার পর উপপরিচালক পদে প্রমোশন হওয়ার কথা। কিন্তু ১৩ বছর চাকরি হয়ে গেছে কিন্তু প্রমোশন পাচ্ছেন না। আবার উপপরিচালক পদে ৩ বছরসহ প্রথম শ্রেণির পদে ১৫বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে পরিচালক হওয়ার কথা। একজন কর্মকর্তা প্রথম শ্রেণির পদসহ উপপরিচালক পদে ২৬ বছর ধরে সার্ভিস দিয়ে আসছেন। যে কারণে কমিশনে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।

আবার অনেকগুলো পদে প্রেষণে নিয়োগ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা প্রেষণে বিইআরসিতে বসে তিতাসের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব মূল্যায়ন করছেন। আরও আনেক ইস্যু রয়েছে যেগুলো ওই পদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তবুও তাদের অফিসারেই ধারাবাহিকভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

২০১৭ সালে অর্গানোগ্রামের খসড়া তৈরি করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রেড-৩ ও তদূর্ধ্ব পদ সৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন আবশ্যক। এরকম ৪টি পদ থাকায় ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণ করে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন না দিয়ে যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা চেয়ে ফেরৎ দেন। তারপর অন্ধকারে চলে যায় বিইআরসির জনবল কাঠামো। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১৮ জুলাই আবার বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। মন্ত্রণালয় প্রায় ৮ মাস আটকে রাখার পর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রেরণ করে। আবার পদসৃজনের প্রাসঙ্গিকতা চেয়ে ফেরৎ দেওয়া হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান প্রথম কর্মদিবসেই অনেকগুলো যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের কথা জানান। ঘোষণা দেন, বিশেষ বিধান আইন বাতিল, নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় না করার। তার ওই ঘোষণা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়, সাধুবাদ জানান ক্যাবসহ ভোক্তাদের সংগঠনগুলো। কয়েক দিনের মথায় নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করার ধারা বিলুপ্ত করা হয়। অনেকে আশাবাদী হয়ে ওঠেন ন্যুজ বিইআরসি গতিশীল ও শক্তিশালী হওয়ার বিষয়ে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সব আলো হারিয়ে যেতে বসেছে। আমলাদের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে অসহায় বিইআরসি।

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের চাপে গঠিত কমিশন নিয়ে শুরু থেকেই আমলারা নাখোশ। তারা কমিশনের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সব সময়ে তৎপরতা চালিয়ে এসেছে। যে কারণে আমলারা প্রতিটি পদে পদে বাঁধার সৃষ্টি করছে। আগের সরকার যে প্রবিধানমালার দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্বাহী আদেশে নির্ধারণ করতো। সেগুলো এখনও ঝুলে রাখার পাথেই হাঁটছে। পনের দিনে কাজে ১ বছরেও শেষ করা যায় নি। ২০১২ সাল থেকে ঝুলে থাকা প্রবিধানমালা অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রথম দিকে নাড়াচাড়া শুরু হলেও এখন আবার অন্ধকারে চলে গেছে। আগের সরকারের আমলাদের মতোই বর্তমান আমলারাও বিষয়টি ঝুলে রাখার পথেই হাটছে। সাবেক আমলা জ্বালানি উপদেষ্টা প্রথম দিকে সিরিয়াস থাকলেও এখন তার আগ্রহেও ভাটার টান দেখছেন কেউ কেউ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকান্ড অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। বিশেষ করে খাতের সুশাসন, শৃঙ্খলা ও সংস্কারে অতীতের মতোই পদে পদে বাঁধার সৃষ্টি করছে বিভাগটি। বিভিন্ন খাতের সংস্কারের কমিশন গঠনের সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে। অথচ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে বিদ্যমান কমিশনকে ন্যুজ করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। একদিকে এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রবিধানমালা আটকে রাখা হয়েছে, অন্যদিকে সংস্থাটির অর্গানোগ্রামও ঝুঁলিয়ে রাখা হয়েছে ৯ বছর ধরে। আর জনবল সংকটের কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।