বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমস। পত্রিকাটির নতুন প্রকাশিত একটি ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’স মিসিং বিলিয়নস: স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট’ শিরোনামের এই অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারিতে আন্দোলনকারী, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা অংশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন- কীভাবে এত বিপুল অর্থ বিদেশে চলে গেল ও আদৌ তা ফেরত আনা সম্ভব হবে কি না।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড বলেন, শেখ হাসিনার শাসনকালে যা ঘটেছে, তার কিছু তো সিনেমার কাহিনির মতো। এ বিষয়ে সে সময়কার শাসকদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ডিজিএফআইর সাহায্যে বিভিন্ন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। এ তথ্যচিত্রে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন এফটির দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান জন রিড, অ্যাগ্রিকালচার ও কমোডিটি করেসপনডেন্ট (আগে বাংলাদেশভিত্তিক সাংবাদিক ছিলেন) সুজ্যানা স্যাভিজ, স্পটলাইট অন করাপশনের ডেপুটি ডিরেক্টর হেলেন টেলর এবং ওয়েস্ট মিনস্টার লবি দলের রিপোর্টার রাফে উদ্দিন। তথ্যচিত্রে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশন দেখিয়ে বলা হয়, স্টেশনটি থেকে বেরোলেই সাইনবোর্ডে লেখা দেখা যায় ‘ওয়েলকাম টু হোয়াইট চ্যাপেল’, কথাটি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লেখা। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কত পুরোনো। যুক্তরাজ্য এখন নির্বাসনে থাকা না থাকা, নানা প্রান্তের বাংলাদেশি রাজনীতিকদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান থেকে পতন: ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা সরকার বিতর্কিত কোটা সংস্কার প্রস্তাব আনে, যা আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়স্বজনকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে ছাত্রসমাজকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। শুরু হয় দেশব্যাপী বিক্ষোভ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব। প্রথম দিকে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ না হলেও ১৪ জুলাই থেকে দমন-পীড়ন শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশ ও সরকারি বাহিনী গুলি চালায়, স্নাইপার ব্যবহার করে এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও শেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতির মোড় ঘোরে ৫ আগস্ট। ওই দিন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানান। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। জাতিসংঘের হিসাবে, এ আন্দোলনে অন্তত ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। হাজারো মানুষ আহত বা নিখোঁজ হন।
দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ: দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ মহলের বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ ছিল। বিশেষত যুক্তরাজ্য হয়ে ওঠে এই পাচারের প্রধান কেন্দ্র। লন্ডনের শক্তিশালী আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট বাজারকে টার্গেট করে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। ডকুমেন্টারিতে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার পরিবারের নামও উঠে এসেছে। রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী হলেও, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অভিযোগ ওঠে, হাসিনা ও রেহানার পরিবার বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। টিউলিপ সিদ্দিকও তদন্তের মুখে পড়েন ও মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন। ফিনান্সিয়াল টাইমস জানায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ৩০০টিরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে। ব্রিটিশ অপরাধ দমন সংস্থা (এসসিএ) এরই মধ্যে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তি জব্দ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের হিসাবে, শেখ হাসিনার সময়ে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।
ব্যাংক দখল ও ভুয়া ঋণ: অভিযোগ রয়েছে, হাসিনা সরকারের সময় সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় সাবেক শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠরা ব্যাংক দখল করে। অস্ত্রের মুখে অনেক পরিচালককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর ওই ব্যাংকগুলো থেকে হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ দেওয়া হয় নিজেদের স্বার্থে, যার বড় অংশ বিদেশে পাচার হয় হুন্ডির মাধ্যমে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় আর্থিক লুটপাট। অনুমান করা হচ্ছে, ব্যাংক ও ব্যবসা খাত থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ২৩ হাজর ৪০০ কোটি ডলার।
পরিবর্তনের হাওয়া: শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। তিনি সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেন ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, অন্তত ১১টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছে। ব্যাংক খাত সচল রাখতে সরকার এরই মধ্যে ২৯ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে বছরের পর বছর সময় লাগবে। ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত গড়ায়।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচনের চাপ বাড়ছে। ড. ইউনূস জানিয়েছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার না করে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভাব্য নির্বাচন হতে পারে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বিশ্লেষকদের মতে, জনগণের প্রত্যাশা এখন আকাশচুম্বী। তবে মৌলিক সংস্কার না ঘটলে বাংলাদেশ আবারও ক্ষমতার একচেটিয়া দখল ও দুর্নীতির ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। সূত্র: ফিনান্সিয়াল টাইমস