প্রতিবছর ১৪ লাখ সিলিন্ডার গ্যাস উৎপাদন করে সরকার। প্রতিটি সিলিন্ডারের বাজার মূল্য ৬৯০ টাকা। কিন্তু সরকারি এলপি গ্যাস কারা ক্রয় করে কিংবা কারা ক্রয় করতে পারেন সে সম্পর্কে ধারণা নেই অধিকাংশ গ্রাহকদের। অথচ সরকারি এলপি গ্যাসের বোতল বাজারে ১৪শ’ থেকে ১৬শ’ টাকায় বিক্রি করছে একটি চক্র। বছরের পর বছর এ চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিপিসিতে মঙ্গলবার অভিযান চালিয়েছে দুদক ।

জানা গেছে, কয়েক দশক ধরে রান্না করে বেতলজাত এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করছে দেশের মানুষ। সম্প্রতি সময়ে লাইনে গ্যাসের অপ্রতুলতায় সিলিন্ডারের চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেই সুযোগে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি দাম বাড়াচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি মাত্র ৬৯০ টাকায় গ্রাহক পর্যায়ে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি করে।

তবে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রিতে বিপিসির বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা লোপাটের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক। বছরে ১৪ লাখ গ্যাস গ্রাহক পর্যায়ে সরকারিভাবে সরবরাহ করার কথা থাকলেও বাজারে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তদন্ত সংস্থা বলছে, বেসরকারি কোম্পানির বোতল ভরে এসব সিলিন্ডার ডিলার-বিপিসির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে।

বিপিসির তথ্যমতে, প্রতি বছর ১৪ লাখ সিলিন্ডার গ্যাস উৎপাদন করে সরকার। অতিরিক্ত ৭শ’ টাকা প্রতি সিলিন্ডারে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যয় হলে প্রতারকদের হাতে চলে যায় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা।

দুদকের সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ বলেন, গ্যাস বিক্রিতে দুর্নীতির অভিযোগে মঙ্গলবার দিনভর বিপিসির কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে উঠে আসে ভয়াবহ চিত্র- সাধারণ মানুষের কাছে যে গ্যাস ৬৯০ টাকায় পৌঁছানোর কথা, সেই গ্যাস বেসরকারি কোম্পানির বোতলে ভরে ১৪শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় বিপিসি থেকে পাওয়া অনিয়মের তথ্যের আলোকে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বিপিসির চেয়ারম্যান মো: আমিন উল আহসান বলেন, অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি এ ধরনের কাজ বন্ধে আন্তরিক চেষ্টা রয়েছে।

জানা গেছে, সরকার প্রতি সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস মাত্র ৬৯০ টাকায় দিচ্ছে, অথচ অধিকাংশ মানুষ তা জানেন না। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটÑযারা বছরে লোপাট করছে কোটি কোটি টাকা!

সাইনবোর্ড এলাকার রাহেলা বেগম প্রতিদিন কাঠ জ্বালিয়ে রান্না করেন। পরিবারে সাতজন সদস্য, মাসে দরকার হয় দুইটি ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার। বাজারে যার দাম প্রায় ২৯০০ টাকা। কিন্তু এই সিলিন্ডারটি যে সরকার মাত্র ৬৯০ টাকায় দিচ্ছেÑতা তিনি জানেনই না। রাহেলা বলেন, “৬৯০ টাকায় যদি গ্যাস পেতাম, এত কষ্ট করে খড়ি জ্বালাতাম না।”

এই চিত্র সারাদেশেই প্রায় একই। বেশিরভাগ মানুষ জানেন না সরকারি দামের গ্যাসের কথা। অনেক দোকানি জানিয়েছেন, তাঁরা কখনোই ৬৯০ টাকার সরকারি সিলিন্ডার পাননি, বরং এই স্কিমের কথা জানাও নেই তাদের। শনি আখড়ার এক দোকানি বলেন, “নয় বছর ধরে গ্যাস বিক্রি করি, এই দামি গ্যাস কোনোদিন দেখিনি।”

তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) গত ৪১ বছর ধরে প্রতিবছর গড়ে ১২ লাখ সিলিন্ডার সরবরাহ করে আসছে। তাহলে সেই বিপুল পরিমাণ গ্যাস কোথায় যাচ্ছে? এক অনুসন্ধানী দলের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে একটি চক্রÑযেখানে ডিলার থেকে শুরু করে কিছু সরকারি কর্মকর্তা পর্যন্ত জড়িত। এই চক্র প্রতিবছর ৭০/৮০ কোটি টাকার গ্যাস সাধারণ মানুষের হাতে না পৌঁছে বেশি দামে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে জনগণ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, রাষ্ট্র হারাচ্ছে রাজস্ব। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি গ্যাস প্রাপ্তির প্রকৃত পথ এবং বিতরণ ব্যবস্থায় প্রচুর অসংগতি রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবেই গড়ে উঠেছে এই ‘গ্যাস সিন্ডিকেট’।

জানা গেছে, বিপিসির এলপিজি ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নীতিমালা অনুসারে একজন ক্রেতা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে মাসে সর্বোচ্চ দুই সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে পারবেন। কিন্তু এই সুযোগে কিছু অসাধু ক্রেতা বিভিন্ন লোককে উপস্থাপন করে একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার কিনে নিচ্ছে। পরে তা খুচরা পর্যায়ে চড়া দামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। ফলে বিপিসির এলপি গ্যাস বাজারজাত প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে অনুমোদিত ডিলাররা দাবি করছেন। এতে ডিলাররা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিপিসির প্রায় ৬ হাজার অনুমোদিত ডিলার রয়েছে। তাদের মাধ্যমে বিপিসির এলপিজি ভোক্তা পর্যায়ে বাজারজাত করা হয়। এ ব্যাপারে এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিপিসির তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিপো রয়েছে। তারা ডিলারদের মাধ্যমে বাজারজাত করছে। এলপি গ্যাস লিমিটেড খুচরা পর্যায়ে সরাসরি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করায় ডিলাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা গ্যাস পাচ্ছে না।