পর্যাপ্ত তথ্যে ও প্রমানের অভাবে চব্বিশের ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামীদের পলায়ন ঠেকাতে পারছেনা ইমিগ্রেশন পুলিশ। যার কারনে মামলার আসামীসহ সন্দেহভাজনরা একের পর এক নানা কায়দায় পালিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এ অবস্থায় পুলিশ সদর দফতর থেকে সকল ইউনিটকে লিখিতভাবে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট মামলার আসামীসহ সন্দেহভাজনদের নাম ঠিকানার সাথে জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট নাম্বার সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের।

গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু হলে, এই আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন শুরু হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনের তীব্রতায় তা দমাতে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃংখলাবাহিনীর সদস্যদের সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও গুলি ছোড়েঁন আন্দোলনকারীদের ওপর। সরকারীদল আওয়ামীলীগসহ তাদের দোসররা ঝাপিয়ে পড়ে ছাত্র-জনতার ওপর। কোন ভাবেই আন্দোলন যখন রোখা যাচ্ছিল না, তখনই দেশ ছেড়ে পালানোর পথ ধরেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ গা ঢাকাও দেন দেশের ভেতরেই। ৫ আগষ্টের আগে ও পরে এই পালানোর চিত্রটি সামনে আসে। এরপর থেকেই পালানোর কাজটি করে চলেছেন সব পেশার সন্দেহভাজনরা। যা এখনও চলছে নানা কায়দায়।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের সময় হতাহতসহ নানা ঘটনায় যেসব মামলা ইতিমধ্যে থানা পুলিশসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে রুজু হয়েছে, পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে সেসব মামলার আসামিদের বিদেশে পলায়ন ঠেকাতে পারছে না ইমিগ্রেশন পুলিশ। এছাড়া সন্দেভাজন আসামিদেরও বিদেশ গমন ঠেকানো যাচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মামলার আসামি ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিদেশ গমন ঠেকাতে পুলিশ সদর দফতর থেকে গত ১১ সেপ্টেম্বর এ ব্যাপারে পুলিশের সব ইউনিটের কাছে বিশেষ লিখিত নির্শেনা জারি করা হয়েছে। ওই নির্দেশনায় বিদেশ গমন রোধের চিঠিতে সংশ্লিষ্ট আসামি ও ব্যক্তির পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নম্বর সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রুজুকৃত মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা আসামিদের বিদেশ গমন রোধের চিঠি দিয়ে থাকে ইমিগ্রেশন পুলিশকে। কিন্তু বেশিরভাগ চিঠিতে সংশ্লিষ্ট আসামির পাসপোর্ট নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর থাকে না। ফলে ইমিগ্রেশন পুলিশ ওই সব আসামিদের বিদেশ যাত্রা ঠেকাতে পারছে না। বিশেষ করে যাদের ব্যক্তি পরিচিতি কম রয়েছে সমাজের কাছে। তাদের ইমিগ্রেশন পুলিশও চেনেনা। এই সুযোগে তারা বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে আসামি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার দায় এসে পড়ছে ইমিগ্রেশন পুলিশের ওপর। যে কারণে ইমিগ্রেশন পুলিশ থেকেই অনুরোধ করা হয়েছে বিদেশ যাত্রা ঠেকানোর চিঠিতে যেন তদন্ত কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট আসামী ও সন্দেহভাজন ব্যক্তির পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সংযুক্ত করেন। এছাড়া বিদেশ যাত্রার নিষেধাজ্ঞার চিঠিতে আদালতের আদেশের কপি সংযুক্ত করারও অনুরোধ করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এ ব্যাপারে স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে পুলিশ সদর দফতরে একটি চিঠি পাঠানো হয়।

জানা গেছে, বৈষমবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ১ হাজার ৭৭৫টি মামলা রুজু করা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলা রুজু করা হয়েছে ৭৭০টি। ইতোমধ্যে ৫৭টি মামলার চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে ১৮টি হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এতে আসামী হয়েছেন ১ হাজার ৯৪১ জন। অন্যদিকে অন্যান্য ধারার ৩৯টি মামলা তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। এতে আসামি হয়েছেন ২ হাজার ২৮৩ জন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-আগষ্টে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগষ্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ওই সরকারের মন্ত্রী এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগরসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতৃস্থানীয়রা এক এক করে দেশ ছেড়ে পালান। এছাড়া সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীরাও দেশছেড়ে পালিয়ে যান। এদের অধিকাংশই চোরাপথে ভারতে ঢোকেন। এরপর সেখান থেকে পালান অন্যদেশে। কেউ কেউ ভারতে থেকে যান। এরপরই পলাতকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ মামলাতেই আসামিদের পাসপোর্ট এবং এনআইডি নম্বর নেই। আবার তদন্ত কর্মকর্তারাও আসামিদের বিদেশ যাত্রা ঠেকানোর চিঠিতে পাসপোর্ট এবং এনআইডি নম্বর যুক্ত না করায় দেশের সব ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টে তাদের বিদেশ গমন ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে।

ইমিগ্রেশন পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, যেসব আসামি পরিচিত ব্যক্তি নন পাসপোর্ট এবং এনআইডি নম্বর ছাড়া তাদের বিদেশযাত্রা ঠেকানো দুরুহ। তবে যারা পরিচিত এরকম সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিদেশযাত্রা ঠেকানো ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে সহজ হয়।