ড. ইউনূসের জাপান সফরে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে। চার দিনের সফরে আজ মঙ্গলবার দিবাগত রাতে জাপান সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফরের অংশ হিসেবে তিনি টোকিওতে আয়োজিত ‘নিক্কিই ফোরাম’ এ অংশ নেবেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও মিলিত হবেন। সফরে দুই দেশ ৭টি সমঝোতা স্মারক সই করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাপানের কাছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা চাইবে। প্রধান উপদেষ্টা ৩১ মে সকালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে টোকিও থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করবেন এবং রাতে ঢাকায় অবতরণ করবেন বলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন। এছাড়াও চলতি বছরের মার্চে চীন সফর করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সফরে প্রধান উপদেষ্টাকে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। এবার জাপান সফরে ড. ইউনূসকে জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেবে।

এবারের নিক্কেই ফোরাম সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও লাওসের প্রেসিডেন্ট, পালাওয়ের প্রেসিডেন্ট, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, সিঙ্গাপুরের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ভিয়েতনামের উপ-প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ প্রমুখ বক্তব্য দেবেন। নিক্কেই ফোরামের সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ফিউচার অব এশিয়া’। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক বিষয় ও বিশ্বে এশিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে খোলামেলা এবং স্বাধীনভাবে তাদের মতামত উপস্থাপন করবেন। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর নিক্কেই ফোরাম আয়োজিত এই সম্মেলনকে এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ফোরাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বছর নিক্কেই ফোরামের ৩০তম বার্ষিকী পূর্তি হচ্ছে।

গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সফর নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী। এসময় উপস্থিত ছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইস্ট এশিয়া এবং প্যাসিফিক উইংয়ের মহাপরিচালক নুর এ আলম। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেন, আগামী ২৮-৩১ মে জাপান সফর করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি ২৭ মে দিবাগত রাতে টোকিওর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। প্রধান উপদেষ্টা ২৯ মে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠেয় নিক্কেই ফোরামে অংশ নেবেন। ২৮ মে দুপুরে জাপান পৌঁছাবেন ড. ইউনূস। ওইদিন বিকেলে জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফ্রেন্ডশিপ লিগের প্রেসিডেন্ট তারো আসো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ২৯ মে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ দূতাবাস, টোকিও আয়োজিত একটি মানবসম্পদ উন্নয়ন সেমিনারে অংশ নেবেন এবং বিশেষ বক্তব্য দেবেন। অদূর ভবিষ্যতে জাপানের প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলাদেশ কীভাবে আরও দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে পারে সে ব্যাপারে সেমিনারে আলোকপাত করা হবে। রুহুল আলম জানান, জাপান সফরকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাইকার প্রেসিডেন্ট সাক্ষাৎ করবেন। সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় জাইকার সহযোগিতা এবং বর্তমানে জাইকার অর্থায়নে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হবে। পরদিন ৩০ মে সকালে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার-এর নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকের আগে প্রধান উপদেষ্টাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা এবং গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। এছাড়াও জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) প্রেসিডেন্ট ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। প্রধান উপদেষ্টা একটি বিজনেস সেমিনারে অংশ নেবেন, সেখানে তিনি জাপান থেকে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানাবেন।

তিনি বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে কৌশলগত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ইস্যু, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষি, অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সহযোগিতা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানসহ দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। ওইদিন দুপুরে জেট্রোর প্রেসিডেন্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, যেখানে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হবে। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বৈঠক শেষে বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিয়ে জাপানি বিনিয়োগকারীদের অবহিতকরণ এবং বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্দেশে আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর তিনি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণের উদ্দেশে আয়োজিত বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার শীর্ষক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। ওইদিন বিকেলে জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান উপদেষ্টাকে একটি সম্মানসূচক ডিগ্রি দেবে।

রুহুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সফরে জাপানের সঙ্গে ৭টি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপনে জাপানের জেবিআইসি ঋণ চুক্তি, ওনডা এবং নাকসিসের সঙ্গে বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) আলাদা দুটি ভূমি সংক্রান্ত সমঝোতা, ব্যাটারি ও সাইকেল কারখানা স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে সমঝোতা, বিডাতে ওএসএস প্রযুক্তি স্থাপন নিয়ে জাইকার সঙ্গে সমঝোতা এবং দক্ষতা ও ভাষা উন্নয়নে মানবসম্পদ বিষয়ক বিএমইটির সঙ্গে আলাদা দুটি সমঝোতা। এ ছাড়া বাজেট সহায়তা ও জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথ ডুয়েলগেজ ডবল লাইনে উন্নীতকরণে এক্সচেঞ্জ অব নোটস স্বাক্ষরিত হবে বলে প্রত্যাশা করা যাচ্ছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশ জাপানের কাছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা চাইবে, এটা সহজ শর্তে ঋণ। তারা আমাদের একটা পরিমাণ দিতে রাজি হয়েছে। আমরা সফরের আগে এটি প্রকাশ করতে পারছি না। শ্রমশক্তি রপ্তানি নিয়ে রুহুল আমিন বলেন, কর্মক্ষম মানুষের চাহিদা জাপান বিদেশ থেকে পূরণ করছে এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের একটি সমঝোতা রয়েছে। এর পরিধি বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের বিএমইটির সঙ্গে জাপানের দুটি বেসরকারি কোম্পানির সমঝোতা হবে। ওই কোম্পানি দুটি জাপানের ভাষা শিক্ষা এবং বিশেষায়িত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে কাজ করবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইস্ট এশিয়া এবং প্যাসিফিক উইংয়ের মহাপরিচালক নুর এ আলম জানান, জাপান মোট ১৬টি খাতে লোক নিতে আগ্রহী এবং এ বিষয়ে তারা ভাষা ও নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ দেবে। এর মধ্যে কেয়ারগিভার, হসপিটালিটিসহ অন্যান্য খাত রয়েছে। সম্প্রতি জাপানের টোকিওতে বাংলাদেশ ও জাপানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার টোকিও সফর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এফওসিতে জাপান থেকে আরও অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ওডিএ) ঋণ, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো এবং বাজেট সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। আলোচনায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রসঙ্গ তোলে জাপান। দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে চুক্তির কথাও উল্লেখ করে জাপান।

প্রধান উপদেষ্টার সফরে কোন বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পারে জানতে চাইলে সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, জাপান থেকে আরও বেশি সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা, একইসঙ্গে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর আহ্বান জানাতে পারে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগের (বিগ-বি) অধীনে সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক, বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগ, বিশেষ করে নার্স ও কেয়ারগিভার, এসব বিষয় গুরুত্ব পাবে। এ সফরে কিছু নতুন প্রকল্পের ঘোষণা আসতে পারে। পাঁচটি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি নিয়ে উভয়পক্ষ কাজ করছে।

সরকারপ্রধানের জাপান সফরের গুরুত্বের বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোওয়ার হোসাইন বলেন, জাপান আমাদের অনেক দিনের উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে এই সফর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জাপান বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার, বিশেষ করে রাখাইন পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সমস্যা, কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনা, ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু-সব বিবেচনায় সফরটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।