সময়ের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে জাতির প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ২০২৫ সালের চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি এ কমিশন গঠিত হয়। বাংলাদেশী-মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের সহসভাপতি করা হয়।
এর উদ্দেশ্য ছিল ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী হাসিনার বিদায় পরবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা এবং রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী (জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান), সফররাজ হোসেন (পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রধান), বদিউল আলম মজুমদার (নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান), বিচারপতি এমদাদুল হক (বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান), ড. ইফতেখারুজ্জামান (দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান) এবং মনির হায়দার (প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী)। তারা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ।
কমিশনকে প্রাথমিকভাবে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ছয় মাস সময় দেওয়া হয়েছিল (যা ১৫ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা)। তবে কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় দুই দফায় এক মাস করে এবং সর্বশেষ তৃতীয় দফায় ১৫ দিন বাড়িয়ে গতকাল ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।
সবচেয়ে বড় কথা হলোÑ ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। জুলাই সনদে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল সই করেছে।
কমিশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে ‘জুলাই সনদ ২০২৫’ এবং সরকারের হাতে ঘোষণাপত্র হস্তান্তর করা। এ প্রসঙ্গে, দেশীয় বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল সনদে সম্মতি দিয়েছে। এসব সুপারিশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে পৌঁছানো হয়েছে এবং পরবর্তী সরকারের কার্যক্রমে তা অন্তর্ভুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও এর কাজ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক সংস্কারে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই, দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক বাঁকে রক্তপাত ঘটেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান প্রতিটি অধ্যায়েই রক্তের দাগ লেগে আছে। এসব রাজনৈতিক বাঁকে সংঘটিত অপরাধের কোনো কোনোটার আংশিক বিচার হলেও বেশির ভাগেরই বিচার হয়নি।
সব শেষ দেখা যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের যে সুপারিশ করেছে, তার কিছু বিষয় নিয়ে দু-একটি রাজনৈতিক দল মত ভিন্নতা দেখিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি কিছু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত দিয়েছে। দলটির ভিন্নমত অনুসারে সংস্কার বাস্তবায়ন করা হলে খুব বেশি মৌলিক পরিবর্তন আসবে না। অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংস্কার প্রস্তাব সংবিধানে যুক্ত করার সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়।
তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কয়েকটি দলের দাবি ছিল, ভিন্নমত অনুসারে নয়, ঐকমত্য কমিশন যেভাবে প্রস্তাব দিয়েছে বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
এখানে প্রণিধান যোগ্য যে, জুলাই জাতীয় সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অন্তত ৩৬টিতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। ১৭ অক্টোবর যে জুলাই জাতীয় সনদ সই হয়েছে, সেখানে কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা উল্লেখ করে রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত অংশে বলা হয়েছে, ‘অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেইমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ার তফসিলে সংস্কার প্রস্তাবগুলোই শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ভিন্নমতের উল্লেখ নেই। আদেশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ‘আদেশের তফসিল-১-এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ’ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে। এর আগে গণভোটও হবে সনদের তফসিলে থাকা প্রস্তাবগুলোর অনুমোদন প্রশ্নে। অর্থাৎ সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে না। কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যই চূড়ান্ত নয়। এখানে জনগণের মতও প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতের সুরক্ষা থাকে।
ঐকমত্য কমিশন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয়ে কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করেছে। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের মতামত ছিল ভিন্নমত রেখে সনদ বাস্তবায়ন করা হলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। কমিশনও সেটাই মনে করে। তা ছাড়া নোট অব ডিসেন্ট হলো একটি সিদ্ধান্তে কারও ভিন্নমতের উল্লেখ। এতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় না।
কথা হলো-- সংবিধান সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কিছু মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন আনা। যেমন ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি কঠিন করা, যাতে কোনো দল ইচ্ছেমতো তা পরিবর্তন করতে না পারে। এ জন্য বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার একটি হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন। এ পদ্ধতিতে সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। নিম্নকক্ষে (সংসদ) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধনী বিল অনুমোদিত হওয়ার পর উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এটি পাস হতে হবে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ হলে একক দলের ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধন কঠিন হবে।
কিন্তু বিএনপি চায় নিম্নকক্ষে পাওয়া আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন। তারা বলছেন, এভাবে উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটি হবে নিম্নকক্ষের অনুলিপি। এতে উচ্চকক্ষ গঠনের মূল লক্ষ্য পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এতে শুধু সংসদ সদস্যের সংখ্যা এবং রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনাতেও বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছিল।
অনেকে মনে করেন, বেশির ভাগ দল ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় তাদের দলীয় অবস্থান ও আদর্শ বিবেচনায় প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সংবিধান শুধু কোনো দলের চিন্তার বিষয় নয়। সংবিধান হলো জনগণের অভিপ্রায়। তাই এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তাবগুলো ভিন্নমত ছাড়া গণভোটে দেওয়ার সুপারিশ যৌক্তিক। এছাড়া ৪৮টি প্রস্তাবের ৩০টির মধ্যে দলগুলোর একধরনের ঐকমত্য আছে। বাকিগুলোতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। কিন্তু কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যই চূড়ান্ত নয়। এখানে জনগণের মতও প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতের সুরক্ষা থাকে।
সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সুপারিশ করা হয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে, প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে গণভোট। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এ সময়ে সংস্কার করতে সংসদ ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। এর জন্য সংস্কার প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার বিল (সংবিধান সংশোধনে আইনের খসড়া) আকারে আদেশের তফসিলে থাকবে। আরেকটি বিকল্প সুপারিশের কাঠামোও একই। কিন্তু সেখানে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না হলে কী হবে, তার উল্লেখ নেই। এখানে তফসিলে থাকবে শুধু সংস্কার প্রস্তাব। তবে নানা প্রশ্ন থাকলেও সনদ বাস্তবায়ন হবে এ নিশ্চয়তা বিধান করতেই মূলত স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হবেÑএমন সুপারিশ এসেছে। কারণ, অনেকে মনে করেন এ রকম বিধান না থাকলে সংস্কারের পরিণতি হবে নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখার মতো। কয়েকটি দলও সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চেয়েছে। এখানে আরেকটি বিকল্প আলোচনায় ছিল, সেটা হলো ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে সংসদ বিলুপ্ত হবে। কিন্তু এটি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এটি ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে, এমন বিবেচনায় সেটা রাখা হয়নি বলে কমিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে কমিশন দুটি বিকল্প দিয়েছে। এর একটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করা যায়, সে জন্য এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আরেকটা বিকল্প পথও বলা হয়েছে। সরকার সেটাও নিতে পারে। তিনি বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় গিলোটিন প্রসিডিউরের ধারণা থেকে তারা প্রথম বিকল্পের সুপারিশ করেছেন। তবে কমিশনের দৃঢ় বিশ্বাস, এত দূর যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সংসদে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সংস্কার সম্পন্ন করবে দলগুলো।
আফসোসের কথা হলো ঐকমত্য কমিশনের সমস্ত পরিশ্রম সফল হতো যদি অন্তত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি হতো। গণভোটের তারিখটা নির্ধারণ হতো।