রাজধানীজুড়ে চলছে দাবি দাওয়ার বহর। চলছে আন্দোলন বিক্ষোভ হুমকি। গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় আজ মঙ্গলবারও বিক্ষোভের হুমকি দিয়েছেন সচিবালয় কর্মচারীরা।
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রত্যাহারের দাবিতে আজ মঙ্গলবার আবারও বিক্ষোভ-মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। একইসঙ্গে একই ধরনের কর্মসূচি পালনের জন্য সারা দেশের সরকারি দপ্তরের কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
সোমবার অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। এখান থেকেই এমন ঘোষণা দিয়েছেন পরিষদের নেতারা। তৃতীয় দিনের মতো শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী দফতরের কাজকর্ম বন্ধ রেখে বিক্ষোভে যোগ দেন। এ সময় সচিবালয়ে প্রবেশের প্রধান গেটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। সেইসাথে, অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন ভবনের সামনে।
পরিষদের নেতারা জানান, নতুন অধ্যাদেশের কারণে চাইলেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া যাবে। আপিলের সুযোগও নেই। তাই অধ্যাদেশের বিতর্কিত ধারা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সময় কর্মবিরতির পাশাপাশি সচিবালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকিও দেন তারা।
বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়রের শপথ পড়ানোর দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন সমর্থকরা। যত দিন সরকার শপথের প্রক্রিয়া শুরু না করবে তত দিন আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন ইশরাক সমর্থকদের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘ঢাকাবাসী’র সমন্বয়ক সাবেক সচিব মশিউর রহমান। সোমবার নগরভবনের নিচতলার সামনের চত্বরে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ও ইশরাক সমর্থকরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। শনিবার সকাল থেকে আন্দোলনকারীরা নগরভবনে অবস্থান নেন। এ সময় প্রধান ফটক ও ভবনে তালা দেওয়া ছিল। নগর ভবনের নিচতলার সামনের চত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নসহ ইশরাক সমর্থকরা। ফলে সেবা প্রার্থীরা সিটি করপোরেশনে এসে ফেরত যাচ্ছেন।
জরুরি বিদ্যুৎ সেবা চালু রেখে মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সোমবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাত দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচির ৬ষ্ঠ দিনে সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন পল্লী বিদ্যুৎ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম। অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন, হয়রানি বন্ধ, মামলা প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবিতে সারাদেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত ২১ মে থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জরুরি বিদ্যুৎ সেবা চালু রেখে আগামীকাল থেকে সমগ্র বাংলাদেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কর্মবিরতি পালন করা হবে। সমিতিতে অবস্থানরত এমআরসিএমগণ সকাল ৯টার মধ্যে একযোগে সকল রিডিং বই জমা দিয়ে শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের মো. আবদুর রহমান খানকে অপসারণের দাবিতে অসহযোগ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। নেতারা জানান, এনবিআরকে ভেঙে দুটি বিভাগ করার জন্য জারি করা অধ্যাদেশ প্রত্যাহারসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলন চলছিল।
রোববার সরকারের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী যথারীতি কাজে যোগ দিয়েছেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়। তবে, অন্যতম দাবি হিসেবে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা না হওয়ায়, তার বিরুদ্ধে অসহযোগ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। নেতারা বলেন, আগামী ২৯ মের মধ্যে চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। তার বিরুদ্ধে আস্থা ও বিশ্বাসের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে পূর্বঘোষিত লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
তাদের দাবির মধ্যে রয়েছেÑরাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কর-রাজস্ব নীতি প্রণয়ন, আহরণ ও ব্যবস্থাপনায় জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পূর্ণকালীন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়াও, সরকার শিগগিরই রাজস্ব সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন নেতারা। তারা আশা প্রকাশ করেন, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জারি করা অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনের লক্ষ্যে সরকার শিগগিরই আলোচনা শুরুসহ কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
জাতীয় কিডনি অ্যান্ড ইউরোলজি ইনস্টিটিউট (নিকডু) ও হাসপাতালে ছয় মাস ধরে বেতন পান না ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বিডি প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মীরা। বেতন আটকে থাকায় ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ রেখে চার ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করেছেন তারা। এতে চরম ভোগান্তিতে পরেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কিডনি রোগীরা। সোমবার বেলা ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত এই কর্মবিরতি পালন করেন স্যান্ডোরের কর্মীরা। এরপর শর্তসাপেক্ষে কাজে ফেরেন তারা। একই সঙ্গে আজ মঙ্গলবারের বকেয়া বিল পরিশোধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না হলে ডায়ালাইসিস সেবা পুরোপুরি বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিকডুর সঙ্গে সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে ডায়ালাইসিস সেবা দিয়ে আসছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডোর। চুক্তি অনুযায়ী ছয় মাসের বিল একসঙ্গে দেওয়া কথা। সে অনুযায়ী গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের বিল চলতি বছরের জানুয়ারির দিকে পাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি এখনো দিতে পারেনি সরকার। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সেন্টার মিলে কোম্পানিটির সরকারের কাছে বকেয়া সাত কোটি টাকা।
স্যান্ডোর কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বাভাবিক সময়ে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বকেয়া বিল দেওয়া হয়। কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলে কর্মীদের বেতনের পাশাপাশি ডায়ালাইজার কিনতেও সমস্যা হচ্ছে। এতে করে সেবা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে।
দাবি আদায়ে আজ মঙ্গলবার থেকে দুই দিনব্যাপী কলমবিরতি কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার বাদে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার প্রতিবাদে এবং ‘কৃত্য পেশাভিত্তিক’ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে কোটা বাতিল ও সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনার দাবিতে এ কর্মসূচি পালিত হবে।
বুধবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সারা দেশে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ কর্মসূচি পালন করবেন। সোমবার আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ অন্যান্য জরুরি সেবা কার্যক্রম এই কলমবিরতি কর্মসূচির আওতাবহির্ভূত থাকবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখির জন্য ২৫ ক্যাডারের ১২ জন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়টি সমাধানের জন্য আশ্বস্ত করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টিকে আটকে রাখা হয়েছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহর প্রতিক্রিয়া
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, সচিবালয়ের কর্মকর্তারা তাদের ক্যু অব্যাহত রাখলে তাদের পরিণতি পতিত হাসিনার মতো হবে। সোমবার বিকেলে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে দেয়া এক পোস্টে তিনি এমন মন্তব্য করেন। পোস্টে হাসনাত লেখেন, জনদুর্ভোগ ও ফ্যাসিবাদ দীর্ঘায়িত করার ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত সচিবালয়ের ক্যু সম্পর্কে সচেতন থাকুন। পাঁচ অগাস্ট পর্যন্ত কালো ব্যাজ ধারণ করে, হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে অফিস করা সচিবালয়ের কর্মকর্তারা তাদের ক্যু অব্যাহত রাখলে তাদের পরিণতি পতিত হাসিনার মতো হবে। পোস্টে তিনি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সাবধান থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সুতরাং, সাবধান!
সাম্য হত্যা নিয়ে আন্দোলন
সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। সোমবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের ভিসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে প্রশাসনিক ভবনের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর বন্ধ গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা বিক্ষোভ করতে থাকেন। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি সাহস বলেন, সাম্য হত্যার বিচার দাবি করে আসছি কিন্তু সেই দাবি পূরণ করা হচ্ছে না। দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত ছাত্রদলের নানা কর্মসূচি চলমান থাকবে। যারা এই হত্যাকা- বিতর্কিত করতে নানা ধরনের ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে তাদেরও বিচার দাবি করেন।
১৩ দিনেও বিচার ও ঘটনার আদ্যপান্ত জানাতে না পারা দুঃখজনক। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতার দায়ে ভিসি ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। দ্রুত ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে তাদের চেয়ার থেকে নামিয়ে দেয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা।