পুলিশ সদর দফতরে জরুরি বৈঠক

তালিকা তৈরিতে মাঠে গোয়েন্দারা

সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়েছে দেশজুড়েই। এতে আলোচনা সমালোচনার পাশাপাশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য চাঁদাবাজীর লাগাম টানতে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান। গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকেই এই সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। এর আগে পুলিশ সদর দফতরে এক জরুরী বৈঠকে এই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। খবর পুলিশ সদর দফতরের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

সোমবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে চাঁদাবাজি বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, যত উঁচু লেভেলের চাঁদাবাজ হোক, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।

এর আগে শনিবার রাজধানীর পুরান ঢাকার মিল ব্যারাকে ঢাকা জেলা পুলিশ লাইন, রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ) ও ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল (টিডিএস) পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মাধ্যমে সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় চাঁদাবাজ ও আধিপত্য বিস্তারকারীদের তালিকা তৈরি হচ্ছে বলে জানান। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকায় এলাকাভিত্তিক গোয়েন্দা পুলিশকে দায়িত্ব দিয়েছি, যাদের রেপুটেশন খারাপ এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে যাদের রেপুটেশন খারাপ, তাদের বিরুদ্ধে প্রিভেনটিভ ডিটেনশন এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সুত্রে জানা গেছে, দেশজুড়ে চাঁদাবাজদের ধরতে অভিযান শুরুর নির্দেশ পুলিশের সকল ইউনিটকে দেয়া হয়েছে। তাতে কয়েকদফা নির্দেশনাও রয়েছে। হাটে মাঠে ঘাটে, বাস, ট্রাক, টেম্পু স্ট্যান্ড, রেল-নৌ-বাস টার্মিনালসহ যে সকল স্থানেই চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটবে সেখানেই সাঁড়াশী অভিযান চালাবে পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃংখলাবাহিনীর সদস্যরা। জড়িতদের ধরে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা দেবে। মামলার তদন্ত শেষ করতে হবে এক সপ্তাহের মধ্যেই। এরপর এক মাসের মধ্যেই মামলার রায় প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।

সুত্র জানায়, চাঁদাবাজির ঘটনার সময় হাতেনাতে কোন চাঁদাবাজ ধরা পড়লেই তাকে অথবা তাদেরকে ডিটেনশন (আটকাদেশ) দেয়া হবে। এরপর ডিটেনশন প্রাপ্তদের জেলে পুরে সেই ঘটনায় মামলা দায়ের করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত কাজ এক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ করতে পুলিশের সকল ইউনিটকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাতে করে এক মাসের মধ্যেই মামলার রায় দেয়া সম্ভব হয়।

ডিটেনশন হচ্ছে, আটকাদেশ অবস্থা। কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর মুক্তি না দিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩(২) ধারা মোতাবেক জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট অভিযুক্ত আসামীকে একটি নিদির্ষ্ট সময়ের জন্য আটকাদেশের নির্দেশ প্রদান করে থাকেন, এই আসামীকে আটক রাখার নামই হলো ডিটেনশন। এর মেয়াদ প্রথম পর্যায়ে ৩০দিন এবং পরে ৯০ দিন এই ভাবে মোট ১২০ দিন একজন আসামীকে বিনা বিচারে আটক রাখা যায়।

সুত্র জানায়, পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ইউনিটের কাছে চাঁদাবাজির ঘটনার যে তথ্য আছে, সেসব ধরেও আগানো হতে পারে। সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে চিহিৃত চাঁদাবাজদের ধরা হবে। এছাড়া, দেশজুড়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চাঁদাবাজদের একটি তালিকা তৈরী করে সেই তালিকা মোতাবেক অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে।

এদিকে, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা করেছে পুলিশ। এ তালিকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, কাঁচাবাজার, ফুটপাত, নৌপথ, সড়ক ও মহাসড়কে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িতরা রয়েছেন। সারাদেশ থেকে পাওয়া তালিকায় রয়েছেন দুই হাজার ৩১ জন।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, গত বছরের জুলাই আগষ্টের তীব্র গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের অকল্পনীয় পতনের পর দেশজুড়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ঘটনা বেড়ে যায়। দেশে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। আইন-শৃংখলাবাহিনীর প্রতি সাধারণ জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ এবং থানার অপারেশনাল কার্যক্রমে ধীর গতির সুযোগে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ অপরাধমূলক কাজ শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতর থেকে বিশেষ শাখার (এসবি) অ্যাডিশনাল আইজির কাছে ১৬ অক্টোবর একটি জরুরী পত্র পাঠিয়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়। এই চিঠি পাওয়ার পর পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে বিদ্যমান ৭২ টি ইউনিটের কাছে তালিকা চেয়ে গোপনীয় পত্র পাঠানো হয়। ওই ইউনিটগুলোকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়। এর মধ্যে ২৯ টি ইউনিট বাদে ৪৩ টি ইউনিট চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের তালিকা করে বিশেষ শাখায় পাঠায়। বিশেষ শাখা থেকে ওই বছরের ৬ নবেম্বর ৪৫৭ পৃষ্ঠার গোপনীয় প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে সারাদেশের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সবিস্তার তুলে ধরা হয়। তাতে ২০৩১ চাদাঁবাজ-সন্ত্রাসীদের নাম উঠে আসে বলে সুত্রটি জানায়।