ইবরাহীম খলিল ঢাকা ও মোঃ শামীম হোসেন সাভার : মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ৭১ এর বীর শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে স্মৃতিসৌধের বেদিতে রাষ্ট্রপতি এবং এরপর ৬ টা ১১ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল তাদের গার্ড অব অনার প্রদান করে।

পুষ্পস্তবক অর্পণের পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায়। প্রধান উপদেষ্টা স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গনে রাখা দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন। প্রধান উপদেষ্টার পর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর একে একে বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক–সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

বহু ত্যাগ তীতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকীতে বৈষম্যমুক্ত বিভাজনহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা ঝরেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠে। গতকাল বুধবার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে একাত্তরের বীর শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠারই প্রত্যয় জানালেন তারা। রক্তিম সূর্য স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে। মনে করিয়ে দেয় ৫৪ বছর আগের ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় কালরাত পার করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত উচ্চারণে বলিষ্ঠ জাতির কথা। বিশ্বের বুকে যাদের পরিচয় হার না মানা জাতি হিসেবে। সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় ৮৪ একরের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। পতাকা আর ফুল হাতে জনতার ঢল নামে সৌধ প্রাঙ্গণে। ব্যানারসহ ফুল দিতে আসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে মূল বেদি।

অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সকাল ৬টা ১১ মিনিটে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাতির বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস দল তাঁকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর।

এরপর শ্রদ্ধা জানান বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। শ্রদ্ধা জানান উপদেষ্টাম-লী ও বিদেশি কূটনীতিকরাও। সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান বিচারপতি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অন্তর্র্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জাতীয় স্বার্থে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা ঐকমত্য পোষণ করব। কিন্তু একেকজন মানুষের চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। সেসব দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলো কমিয়ে আনতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। একটা সরকারের জন্য গতানুগতিক কিছু চ্যালেঞ্জ তো থাকেই। তবে এখন একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য গড়া। সেটা অবশ্যই একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এটাকে চ্যালেঞ্জ বলেন আর না বলেন, একটা প্রক্রিয়া তো বটেই। আমাদের জন্য ওটাতে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াকে একটা বড় বিষয় বলে আমি মনে করি। আরেকটা হচ্ছে- নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে করে দেওয়া, জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা।

রাজনৈতিক দলগুলো সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকেই প্রধান্য দেবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের অনেকের চেয়ে তারা তো আরও অনেক বেশি অভিজ্ঞ। ফলে আমি মনে করি জনগণকে আস্থায় যদি আনতে হয়, তাহলে যে সংস্কারগুলোর দাবি জনগণের ক্ষেত্রে ওঠে, সেগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যে না পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। সবসময় জনগণের মতামতের সঙ্গেই আছি। আমরা তাদের জন্যই কাজ করছি।

এ সময় স্বাধীন ভূখ-ে এ দেশের মানুষ আর পরাধীন বোধ করবে না বলে মন্তব্য করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ৭১-এ দেশকে জন্ম দিয়েছেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা। কিন্তু বিগত ১৬ বছরে স্বাধীনতার যে কনসেপ্ট সেটাকে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। আমরা মনে করি, দেশের প্রত্যেকটা নাগরিক যতক্ষণ না মনে করবে সে স্বাধীন, তার বাক স্বাধীনতা আছে, তার ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভূখ- স্বাধীন হয়ে কোনো লাভ নেই। আমরা মনে করি, ২৪ সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করেছে। এই স্বাধীনতা সামনের দিনগুলোতেও থাকবে। আর কখনোই একটি স্বাধীন ভূখ-ে এ দেশের মানুষ আর পরাধীনতা বোধ করবে না।

সকাল আটটার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিএনপির নেতারা। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ইরফান ইবনে আমান, ঢাকা জেলা যুবদলের সভাপতি ইয়াছিন ফেরদৌস মুরাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে বাংলাদেশে কিছু নেই’ মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সাংবাদিকদের বলেন, যারা আজকের স্বাধীনতা দিবসকে খাটো করতে চান, একাত্তরের স্বাধীনতায় তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সুতরাং এই দিনটাকে তারা খাটো করতে চান। আমি বলব, তারা যেন এখানেই বিরত থাকেন। এই স্বাধীনতা দিবসকে যেন সম্মান জানান এবং সম্মান করেন। জুলাইু-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন করে স্বৈরাচারকে তাড়িয়ে স্বাধীনতার নতুন স্বাদ পেয়েছি। অনেকে বলেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা। আসলে আজকের স্বাধীনতা দিবস প্রমাণ করে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে বাংলাদেশে কিছু নেই।

তিনি বলেন, প্রত্যেকটা দলের নিজস্ব আদর্শিক জায়গা ও মতাদর্শ আছে। সবাই যার যার মতাদর্শ থেকে কথা বলে। এটাকে আমি অনৈক্য বলবো না। তবে দলগুলোর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত আছে। যদি কখনও এমন সময় আসে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। তখন কিন্তু আমরা সবাই এক হয়ে যাব। এখানে কোনো ভুল নাই। এখন দলীয় আদর্শিক স্বার্থে হয়তো আলাদা কথা বলছি। কিন্তু যখন জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হবে, তখন বাংলাদেশের জনগণ এক হয়ে যাবে।

সকাল সাড়ে আটটার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। এ সময় এনসিপি’র সদস্যসচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, মুখ্য সমন্বয়ক নাছির উদ্দিন পাটোয়ারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন দিলে মেনে নেওয়া হবে না মন্তব্য করে এসসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমাদের জাতীয় নাগরিক পার্টির যে দাবী বিচার ও সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচন। আমরা মনে করি সেই পথে গেলেই জাতির একটি উত্তরণ ঘটবে গণতন্ত্রের পথে। সংস্কার এবং বিচারবিহীন যদি নির্বাচন দেওয়া হয় এবং কোনো একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যই নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হয় সংস্কার ছাড়া তাহলে তা অবশ্যই মেনে নেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, এদেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, ন্যায় বিচারের জন্য। এরই ধারাবাহিকতা ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান। আমরা মনে করি যে আমাদের একটি স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এবং বারবার এটা বেহাত হয়েছে এবং বারবার রক্ত দিতে হয়েছে জনগণকে। আমাদের যাতে সামনের দিনগুলোতো আর রক্ত না দিতে হয় জনগণের এই প্রত্যাশা আমাদের আজকের দিনে। আমাদের যে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করেছি যুগ যুগ ধরে এবং ২০২৪ সালেও আমাদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন করতে হয়েছে।

নাহিদ ইসলাম আরো বলেন, আমরা মনে করি, ৭১ এবং ২৪ আলাদা কিছু নয়, বরং ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই ৭১-এর যে স্পিরিট সেটা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেটা ৫৪ বছরে অর্জিত হতে পারেনি বিধায় একটা ফ্যাসিজম ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে চেপে বসেছিল।

এবার এমন এক সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে, যখন চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পথ ধরে তরুণ প্রজন্ম ‘বৈষম্যহীন’ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছে। প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচির সূচনা হয়।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে জয় বাংলা স্লোগান, আটক ৩

মহান স্বাধীনতা দিবসে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ঝটিকা মিছিল করেছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এসময় ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে উপস্থিত জনতা। বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।পুলিশ জানায়, বেলা ১১টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা নিয়ে কয়েকজন শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে ফেরার সময় তারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেন। এসময় উপস্থিত জনতা তাদের ধাওয়া করে। অধিকাংশ নেতাকর্মী পালিয়ে গেলেও তিনজনকে আটক করে পুলিশের সোপর্দ করে জনতা।

আটকরা হলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা (৪৭), সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম (৫০) ও ঢাকার আশুলিয়া থানার দক্ষিণ গাজীরচট শেরআলী মার্কেট এলাকার মো. সোহেল পারভেজ (৪১)। সোহেল পারভেজ সাভারের সাবেক এমপি মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন বলে জানা গেছে। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিনুর কবির তিনজন আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির সময় তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের থানা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।