যখন দেখলাম আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদ কায়েম করে রাখতে চায়। যখন দেখলাম যে আমাদের ভাইদের হত্যা করা শুরু করেছে, তখন আমরা আন্দোলনকে অভ্যূত্থানের দিকে নিয়ে গেলাম--- তারিকুল ইসলাম সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক

এডভোকেট তারিকুল ইসলাম। আহ্বায়ক জাতীয় যুবশক্তি ও জুলাই গণঅভ্যূত্থানের সাবেক সমন্বয়ক। জুলাই বিপ্লবের কারণ লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক সংগ্রামের সাথে।

প্রশ্ন : জুলাই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কি ছিল ?

তারিকুল ইসলাম : ২০২৪ সালে আমরা যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করি, তখন আমাাদের মূল লক্ষ্যের জায়গাটা ছিল- দেশে যে বিরাজমান বৈষম্য, সেই বৈষম্য আবারো ফিরিয়ে আনা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে; যেখানে শতকরা ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করা হয়েছিল। তখনো আমরা কোটা পুনর্বহাল চলবে না, কোটা সংস্কার চাই, এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা সক্রিয় হই। তখনও আমাদের মূল জায়গাটা ছিল যে আমার বাংলাদেশের মধ্যে বৈষম্য দেখতে চাই না। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে অটল ছিলাম। শুধু মাত্র চাকুরীতেই কোটা বৈষম্য চাই না বিষয়টা এরকম ছিল না। আমাদের বয়ানে স্লোগানে সব জায়গাতে বলেছি যে, সকল বৈষম্য যেন দূর হয়। সেই দাবি সরকারকে মেনে নিতে বলেছিলাম।

প্রশ্ন : তখনতো ছাত্র ছিলেন। ছাত্র হয়েও আপনারা নির্দিষ্ট দাবির বাইরে দাবি করেছিলেন কেন ?

তারিকুল ইসলাম : দেখুন আমরা যারা গণঅভ্যূত্থানের নেতৃত্বে ছিলাম, তারা কিন্তু দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে কোটা সমস্যা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ছিলাম ঢাকা বিশ্¦বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। বিভিন্ন অ্যাক্টিভিজমে থাকার কারণে বহু বছর ধরেই আমরা দাবি জানিয়ে এসেছি, এবং এর আগেও আমরা ২০১৮ সালে কোটি বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। আন্দোলনের কারণে গ্রেফতার হয়ে ৪০ দিনের মতো কারাবন্দী ছিলাম। এরপরও রাষ্ট্রের বৈষম্য নিয়ে আমরা কথা বলেছি। আওয়াজ তুলেছি। সেই জায়গা থেকে আমরা যখনই দেখলাম ২০২৪ সালের জুন মাসে কোটা পুনর্বহাল করা হয়েছে, তখন আমরা গোটা রাষ্ট্রের মধ্যেই বৈষম্য দূর করার স্লোগান তুললাম। আমাদের স্লোগান ছিল কোটা না মেধা, মেধা-মেধা। এতে বোঝা যায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যে বৈষম্য রয়েছে, অন্য যে বৈষশ্য রয়েছে সেই বৈষম্য থেকে বের হয়ে যেন মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে পারি, সেজন্যই শুরু থেকে আন্দোলন করেছিলাম।

প্রশ্ন : আপনারা যে স্লোগান দিয়েছিলেন তাতে এক ধরণের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল আসলে আপনার কি করতে চান।

তারিকুল ইসলাম : দেখুন আমরা যখন কোটা আন্দোলন শুরু করি তখন, রাজনৈতিক দল করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দেশে কোন বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু আমরা দেখলাম রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্যের বীজ বুনেছে, কোনভাবেই সেখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা মনে করেছি যে এই বৈষম্য ছিল যুব সমাজকে বন্দী করে রাখার একটি প্রয়াস। এই যুব সমাজ কিন্তু রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি। তাদের অবস্থাতো এমন যে চাকুরী হয়েছে কি-না এই প্রশ্নের জবাব না থাকায় বাড়িতে যায় না। তাদের হতাশাতে রাখাই আওয়ামী লীগের ইচ্ছা ছিল। আমরা মনে করি যে এই সরকার যদি ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকে, তাহলে বৈষম্যে জায়গাটা আরও পাকাপোক্ত করবে। তরুণ সমাজকে আরও গৃহবন্দি করে ফেলবে। এমন করবে যে যাতে তরুণ সমাজ এসব বিষয় নিয়ে না ভাবে। রাজনীতি নিয়ে যেন সক্রিয় না হয়। আমরা চেয়েছি যে এটা কখনো হতে দিবো না। তখনই আমরা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন নামের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি।

প্রশ্ন : কোন প্রেক্ষাপটে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় ?

তারিকুল ইসলাম : ২০২৪ সালের ৫ জুন যখন হাইকোর্ট রায় দিল। সেদিন রাতেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে থেকে আমরা প্রতিবাদ জানাই। এরপর দিন থেকে আন্দোলন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সারাদেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও আমরা আন্দোলনের ডাক দেই। এরপর সারাদেশের বিশ^বিদ্যালয় থেকে একই ডাক আসে যে কোটা পুনবর্হাল চলবে না। আমাদের যৌক্তিক দাবি না মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের ভাইদের ওপর গুলি চালায়। আপনি জানেন যে, ২০২৪ সালের ১১ই জুলাই কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ে আমাদের ভাইদের ওপর গুলি চালানো হয়। এবং ১৬ জুলাই সর্বপ্রথম আমাদের ভাইদেরকে শহীদ করা হয়। সেদিন আবু সাঈদ শহীদ হয়। সাথে আরও ৭ জনকে শহীদ করা হয়। তাতে বোঝা যায় সরকার দাবিয়ে রাখতে চায় যারাই বৈষম্য দূর করতে চায়। তারা ছাত্র সমাজকে দাবিয়ে রাখতে চায়। ফ্যাসিবাদ কায়েম করে রাখতে চায়। যখন দেখলাম যে আমাদের ভাইদের হত্যা করা শুরু করেছে, তখন আমরা আন্দোলনকে অভ্যূত্থানের দিকে নিয়ে গেলাম। পরবর্তীতে আামাদের পক্ষ থেকে ৯ দফা ঘোষণা করি। এরপর আমাদের শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম আসিফ মাহমুদসহ তাদের গুম করা হয়। আয়না ঘরে রাখা হয় এবং তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। এরপরও কিন্তু তারা দমে যায়নি। তাদের আপোষহীন অবস্থান ব্যক্ত করে। যখন দেখলো তাতেও দমন করা যাচ্ছে না তখন আমাদের বাসায় রেড দেয়। ৬জন শীর্ষ সমন্বয়ককে নিয়ে ডিবির গারদে রাখা হয়। এরপরও যারা বাইরে ছিলাম তারা কিন্তু আন্দোলন চালিয়ে যাই। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে সরকার নারী শিশুকে হত্যা করতে পারে তাদের কাছে দাবি করে লাভ নাই। তখনই আমরা এক দফার দিকে যাই। ২আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আমরা এক দফা ঘোষণা করি। আমরা বলেছি শেখ হাসিনার পতন আমরা চাই। পুরাতন যে বন্দোবস্ত বাতিল করে নতুন বন্দবোস্ত চাই।

প্রশ্ন : অভ্যূত্থানের এক বছর পার হলো। আপনাদের প্রত্যাশা প্রাপ্তির মেলবন্ধন সম্পর্কে জানতে চাই।

তারিকুল ইসলাম : জুলাই অভ্যূত্থানে আমাদের যে প্রত্যাশা তা কেবল আমরা যারা জীবিত আছি তাদের প্রত্যাশা তা নয়। আমাদের যারা শহীদ, যারা আহত, চোখ হারিয়েছে, হাত-পা হারিয়েছে, হাত হারিয়েছে অঙ্গহানি হয়েছে, সবার প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারও শহীদদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। মূল ম্যান্ডেটা বিচার এবং সংস্কার থেকে তারা পুরোপুরি সরে গেছে। বিচার সংস্কার বাদ দিয়ে নির্বাচনের দিকে ঝুঁকেছে। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতার পালাবদলের হাতিয়ার হিসেবে রূপান্তর করেছে। এই সরকারের ম্যান্ডেড বিচার এবং সংস্কার। তাদের সেই ধরনের কোন সফলতা দেখতে পাচ্ছি না। পুরণো বন্দবোস্তকে আঘাত করতে দিয়ে যে ধরণের প্রেসার আসছে সেই আঘাত মোকাবেলা করতে পারছে না। এই প্রেসার সামলাতে পারছেনা বলেই আমরা মনে করি সরকার জনপরিসরে দুর্বল সরকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল যেখানে দ্বিমত পোষণ করছে সেখানে যাওয়ার সাহস করছে না। লন্ডনে গিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। আমরা কখনই আশা করিনি যে সরকার এরকম দুর্বল অবস্থায় পতিত হবে। আমাদের সংশয় হয় যে মাত্র কয়েকজন উপদেষ্টা জনগনকে ফেইস করেন। বাকীদের কেউ কিন্তু চিনে না। যারা জনগণকে ফেইস করতে পারে না তারা কিভাবে সংস্কার করবে। আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাই তারা যেন সক্ষমতা অর্জন করে। এখনো সেই সুযোগ রয়েছে। তারা যেন জনগণের আকাংখার কথাটা মনে রাখে। কারণ সরকার কিছু রাজনৈতিক দল বিএনপির দ্বিমতকে যেভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে সেভাবে জনমতকে প্রাধান্য দিচ্ছে না। বিএনপির দ্বিমতকে যেভাবে গ্রহণ করছে তেমনি জনপ্রত্যাশা, শহীদদের প্রত্যাশাকে ডিনাই করছে। তারা যদি এই পথেই থাকে তাহলে সরকারের সকল উপদেষ্টাকে জনগণের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে।