রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারানো শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী তার নিজ গ্রামে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর, যখন সবাই দিগ্বিদিক ছুটছিল, তখন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসংখ্য শিশুকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন এক মহীয়সী নারী— মাহরীন চৌধুরী। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই সমন্বয়ক নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকে একচুলও নড়েননি। অগ্নিকাণ্ডের সময় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাই ছিল তার একমাত্র ব্রত। তার এই আত্মত্যাগ সারাদেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে।
বিমান বিধ্বস্তের পরপরই যখন স্কুলের একটি ভবনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন মাহরীন চৌধুরী শিশুদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী এক হৃদয়বিদারক ফেসবুক পোস্টে বোনের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, মাহরীন আপু (মাহরীন চৌধুরী) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আমার বড় বোন, যিনি আমাকে মায়ের মতো করে বড় করেছেন। তিনি মাইলস্টোন স্কুলের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। ভবনে আগুন লাগার সময় তিনি সবার আগে নিজে বের হননি, বরং যতজন ছাত্রছাত্রীকে পারা যায়, বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে তার শরীরের ১০০ শতাংশ অংশ পুড়ে যায়।
মুনাফ মজিব চৌধুরীর পোস্ট থেকে জানা যায়, মাহরীন চৌধুরী গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন। তিনি রেখে গেছেন তার দুই ছেলে। এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাহরীন চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অসংখ্য পোস্ট চোখে পড়ছে। তার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা তাকে ‘বীর’ হিসেবে বর্ণনা করে আবেগঘন লেখালেখি করছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ফেলিসিয়া ডরোথিয়া হেমানসের বিখ্যাত কবিতা ‘ক্যাসাবিয়াঙ্কা’র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কবিতাটিতে একটি সাহসী ছেলের গল্প বলা হয়েছে, যে তার বাবার নির্দেশ মেনে জ্বলন্ত জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত পুড়ে মারা গিয়েছিল, কিন্তু নিজের স্থান ত্যাগ করেনি।
জানা গেছে, নিহত প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীর আগামী ২৮ জুলাই গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। পরে সোমবার দুপুর ১২টার দিকে এলাকার কয়েকজনকে কল করে বলেন, এ মাসে আসতে পারছেন না। পরের মাসে আসবেন। এর এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে দুর্ঘটনাটি ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। মঙ্গলবার গ্রামের বাড়িতে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মাহরীন চৌধুরীর বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকার পৌর এলাকায়। সেই বাড়িতে গেলে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আবদুস সামাদ এ তথ্য জানান। মাহরীন চৌধুরী বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি তাদের পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গতকাল পৌরসভার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আবদুস সামাদ বলেন, মাহরীন চৌধুরীরা দুই ভাই, দুই বোন। গ্রামের বাড়িতে তাদের কেউ থাকেন না। তিনি বাড়ি দেখাশোনা করেন। মাহরীন চৌধুরী গত ২১ জুন সর্বশেষ গ্রামের বাড়িতে এসে তিন দিন ছিলেন। তিনি যে কলেজের সভাপতি, ওই কলেজের একটি সভায় যোগ দিতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আগামী ২৮ জুলাই তাঁর গ্রামের বাড়িতে আসার কথা ছিল। গতকালই কল করে বলেন, ২৮ তারিখ আসতে পারবেন না, পরে আসবেন। কিন্তু এর আগেই তিনি লাশ হয়ে এলেন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে লাশবাহী গাড়িতে মাহরীন চৌধুরীর লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে। এ সময় সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় অশ্রুশিক্ত চোখে স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁকে শেষবিদায় জানান। বিকেল ৪টার দিকে বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে তাঁর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়। মাহরীন চৌধুরীর দুই ছেলে। বড় ছেলে মিয়াত চৌধুরী দশম শ্রেণিতে পড়ে। সাইফ চৌধুরী ছোট। স্বামী মনছুর হেলাল প্রাইড গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক। মাহরীন চৌধুরীর বাবা মহিতুর রহমান চৌধুরী ২০১৪ সালে এবং মা ছাবেরা চৌধুরী ২০২০ সালে মারা যান।
সাহসী ও মানবিক শিক্ষিকা মাহরিনকে
শায়িত করা হলো বাবা-মায়ের পাশে
নীলফামারী সংবাদদাতা : রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করা সাহসী ও মানবিক শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরীকে শায়িত করা হলো বাবা-মায়ের কবরের পাশে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে মরহুমার গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাযা নামায শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় তাকে।
জানাযা নামাযে জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন, জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ও নীলফামারী-৩ আসনের জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী ওবায়দুল্লাহ সালাফী, জলঢাকা উপজেলা আমীর মোখলেছুর রহমান, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আলহাজ্ব সৈয়দ আলী, বিএনপি নেতা তাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী, শরিফুল ইসলাম বাবু, মরহুমার স্বামী মনসুর হেলালসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশ নেয়। জানাযা নামাযে ইমামতি করেন স্থানীয় মসজিদরে পেশ ইমাম মাওলানা মুনাব্বিরুল হক।
মরহুমা মাহরিন চৌধুরী রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) ছিলেন। গত সোমবার অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে সাতটায় তার মৃত্যু হয়।
মরহুমার স্বামী মনসুর হেলার জানান তার স্ত্রী ইচ্ছে করলে নিজেকে বাঁচতে চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু সে তা না করে তার শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করে যান। শ্রেণি কক্ষের ভিতরে থেকে একের পর এক শিক্ষার্থীকে টেনে বের করতে থাকেন। এক পর্যায়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে সে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এখানেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।