গতকাল রোববার রাজধানীর মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো সংস্কারে নাগরিক উদ্যোগ ‘নাগরিক কোয়ালিশন’ আয়োজিত ‘সংবিধান সংস্কারে নাগরিক জোটের ৭ প্রস্তাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, বাংলাদেশে একটি রিপাবলিক তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ছাড়া নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থা-সম্পর্ক স্থাপনে নতুন সংবিধানের বিকল্প নেই বলেও মত দেন তারা। তবে বক্তারা বলেছেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ষংবিধান প্রণয়নে ২-৩ বছর লেগে যেতে পারে। সভায় সংবিধান সংস্কার, ন্যায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাতটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
সভার শুরুতে বক্তব্য রাখেন আলোকচিত্রী ও নাগরিক কোয়ালিশনের সহআহ্বায়ক শহিদুল আলম। এ সময় নাগরিক জোটের সাত প্রস্তাব তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মোহাম্মদ শাহান। আর প্রস্তাবগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা তুলে ধরেন লেখক জিয়া হাসান।
আলোচনা সভায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন, জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, দলটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবির, এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে ২-৩ বছর লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ সংবিধান প্রণয়ন করে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে, এমনও ধারণা আছে, ৮-৯ বছর লেগেছে। সুতরাং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে বহুদিন লাগতে পারে। তাহলে এখন আমি ৭২-এর সংবিধান কনটিনিউ করব? নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সামনে যে সংসদ থাকবে সে সংসদ সংবিধান পরিচালক হিসেবে কাজ করবে। ৭২-এর সংবিধানের প্রয়োজনে তারা অ্যামেন্ডমেন্ট করবে।
আসিফ নজরুল বলেন, গণপরিষদ যখন কাজ করবে তারা নতুন সংবিধানের কাজ করতে থাকবে। ওটা করতে আমার ধারণা ২-৩ বছর লাগতে পারে। এই ২-৩ বছর কি আমি ৭২-এর সংবিধান গ্রহণ করব? এই ২-৩ বছরের জন্য সংসদের কিছু মৌলিক যেমন-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, আর্টিকেল ১৭, উচ্চ আদালতের ডিসেন্ট্রালাইজেশন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা- এই মৌলিক জিনিসগুলো জাতীয় সংসদ পরিবর্তন করতে থাকবে।
জুলাই সনদ সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা ধরেই নিয়েছি, সবাই জুলাই সনদের ওপর অনেক কিছুতে একমত হবে না। হয়তো এমনও হতে পারে জুলাই সনদের ফান্ডামেন্টাল কিছু জিনিস রাখা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদে থাকা নিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, এটা জনপ্রিয় দাবি। আমারও দাবি। প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদে বললে তো হবে না, আপনাকে কনভিন্সিং তর্ক করতে হবে। পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে এটা আছে বের করেন। প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদ কোথাও নাই আসলে। ভারত বলেন, যুক্তরাজ্য বলেন কোথাও নাই। দুই মেয়াদ সমাধান না। সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাটা কমিয়ে নেওয়া।
বাংলাদেশে একটি নতুন রিপাবলিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের চেষ্টার কথা তুলে ধরে সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি রিপাবলিক তৈরির চেষ্টা চলছে। এটি কেবল রাজনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থেকে উদ্ভূত এক প্রয়াস। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছেন ও আহত হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়েই আমাদের নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর কথা ভাবতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়তে হলে শুধু বর্তমান সংকট বিবেচনায় নিলেই চলবে না, অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মিলিয়ে সমন্বিত রূপকল্প প্রণয়ন করতে হবে। আলোচনায় ড. রীয়াজ বিদ্যমান সংবিধান নিয়েও তীব্র সমালোচনা করেন। তার ভাষায়, সংবিধানের মধ্যে এমন কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যেখানে শেখ হাসিনার মতো একজন নেতার একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কোনো সাংবিধানিক বাধা ছিল না। ফলে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে এবং নির্বাহী বিভাগকে যদি অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে গণতন্ত্র কখনোই কার্যকর হতে পারে না। আমাদের সংবিধান ও শাসন কাঠামো এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ড. রীয়াজ বলেন, উচ্চকক্ষের প্রধান দায়িত্ব হবে আইন ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার নজরদারি ও মূল্যায়ন। তবে একে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিলে এটি নিম্নকক্ষের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে যেতে পারে যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি হতে পারে। তাই ভারসাম্য রক্ষা করেই এই কাঠামো তৈরি করতে হবে।
দমন-পীড়নের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিজেদের রাজনীতির মৃত্যু ঘটিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস দমন আইনে সংশোধন এনে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের (আওয়ামী লীগ) রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে-সেটুকুকে আমরা স্বাগত জানাই। এখানে আপনাদের বুঝতে হবে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে স্বীকৃতি কি এখন পৃথিবী দেয়? দেশের মানুষ দেয়? আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী শক্তি, আওয়ামী লীগ একটি মাফিয়া শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদ ও মাফিয়াতন্ত্রের চর্চা করেছে বাংলাদেশের মানুষের ওপরে এবং তারা যে অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্যাতন-গণহত্যার মধ্য দিয়ে তাদের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে, নিজেদের রাজনীতির মৃত্যু ঘটিয়েছে।
আওয়ামী লীগে রাজনীতি চর্চা নেই মন্তব্য করে সালাহউদ্দিন বলেন, এটা একটা মাফিয়া পার্টি, মাফিয়া শক্তি, এটা একটা ফ্যাসিবাদী দল। সুতরাং রাজনৈতিক দলের কোনো তকমা দিতে চাই না। আওয়ামী লীগের ডিএনএতেই গণতন্ত্র নাই, রাজনীতি চর্চা হবে কীভাবে?
সংলাপ অনুষ্ঠানে সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য যেই পলিটিকাল পার্টি হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং তার অ্যাসোসিয়েটদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার জন্য যে বিধানটা করা হবে, সেই আইনে কিছুটা সংশোধনী আনতে হবে মনে হয়। কারণ ওখানে দল নিষিদ্ধের কথা বলা আছে, সম্ভবত কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে গেলে সেখানে কিছু সংশোধনী আনতে হবে, সেটা এনে তারপর প্রজ্ঞাপন হলে ভালো হবে। এটা হচ্ছে আমাদের পক্ষ থেকে এই জাতির আকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদের রক্তের প্রত্যাশা আকাক্সক্ষা এদেশের জনগণের প্রত্যাশা যে বাংলাদেশে যেন কোনদিন স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদের উৎপাদন না হয়। আওয়ামী লীগের বিচারের জন্য সংশোধিত আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে আইন উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ জানান বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, যেন ন্যাশনালি ও ইন্টারন্যাশনালি বলতে না পারে যে সুষ্ঠুভাবে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। সেই বদনাম যেন আমাদের না হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নতুন সংবিধান প্রণয়ন ছাড়া নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই। নতুন সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থা ও সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। তিনি বলেন, বিগত সময়ের সংবিধান মানবাধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থা ও সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। আমাদের মৌলিক সংস্কারের দিকে এগোতে হবে। মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য না হয়ে অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একমত হওয়া ফলপ্রসূ হবে না।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, বিচার কার্যক্রমের একটি অংশ ইতোমধ্যে এগিয়েছে। এখন প্রয়োজন বিচারিক রোডম্যাপকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা। এতে জনগণের মধ্যে আস্থা জন্মাবে।
সভায় উপস্থিত অন্যান্য নেতারাও সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। সভায় বক্তারা নতুন সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানান। নাগরিক সমাজের মতে, এটা শুধুই রাজনৈতিক সংস্কারের নয়, গণতন্ত্র পুনর্নির্মাণের লড়াই।