২০২৪ সালের ১৮ জুলাই সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা পয়েন্টে আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলী চালায় পুলিশ। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম, অপস অ্যান্ড ট্রাফিক) আবদুল্লাহিল কাফী, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম ও সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে খুব কাছ থেকে গুলী করা হচ্ছিল সেদিন। বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে পুলিশের সাঁজোয়া যানের সামনে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ইয়ামিন। গুলীতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় তার বুক। তারপর আন্দোলনকারীদের ‘শিক্ষা’ দিতে গুলীবিদ্ধ মুমূর্ষু ইয়ামিনকে সাঁজায়ো যানেই সড়ক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একপর্যায়ে টেনে ফেলে দেওয়া হয় সড়কে। এ ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যিনি ভিডিওটি করেছিলেন দৈনিক সংগ্রামের সাভার সংবাদদাতা মো. শামীম হোসেন। তিনি বলেছেন সেদিনের ঘটনা। অনুলিখন ইবরাহীম খলিল।
সাভারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ইয়ামিন হত্যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। আমার চোখে সেদিনের স্মৃতিগুলো জ¦লজ¦ল করছেÑ জীবনে সেদিনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।
১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ২০২৪। এক বছর আগে এই দিনেই সাভারের রাজপথে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ উঠেছিল। আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরমে যখন হাজারো বিক্ষোভকারী নিজেদের অধিকারের দাবিতে মুখর, তখনই নির্মমভাবে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল ইয়ামিনের বুক। বুলেটের আঘাতে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল একটি প্রাণ, এক স্বপ্ন, এক মায়ের সন্তান।
২০২৪ সালের সেই ১৮ জুলাইয়ের কথা ভাবলে আজও গা শিউরে ওঠে। সেদিনের রাজপথ ছিল এক রণক্ষেত্র। একদিকে পুলিশ সাঁজোয়া যান থেকে টিয়ারশেল আর গুলী ছুঁড়ছিল, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের লোকজন অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হয়েছিল। এমন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে অকালে ঝরে গিয়েছিল ইয়ামিনের জীবন।
গত বছরের ১৮ জুলাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা ইউটার্ন এলাকায় অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্য। আন্দোলনকারীরা তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে টিয়ারশেল ছুঁড়লে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় আন্দোলনকারীরা। ভাঙচুর হয় কয়েকটি পুলিশ ভ্যান। দুপুর ২টা থেকে ২টা ২০ মিনিটের মধ্যেই ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। পুলিশের গুলীর মধ্যে আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে সাঁজোয়া গাড়ির ওপর উঠে পড়েন শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। খুব কাছ থেকে পুলিশের ছোঁড়া শটগানের গুলীতে ইয়ামিনের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তারপর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা ইয়ামিনকে সেই সাঁজোয়া যান থেকেই রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাক্ষী হয়ে গিয়েছিলাম সেই পৈশাচিক হত্যাকা-ের। একদিকে ছাত্রজনতা আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ছিলো। অন্যদিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের দমাতে তাদেরকে লক্ষ্য করে টিয়ারশেল, গুলী ছুঁড়ছিল। এরমধ্যেই হঠাৎ করে আমার চোখে পড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হাইওয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে মনসুর মার্কেটের সামনে পুলিশের সাঁজোয়া যানের উপরে একজন তরুণের নিথর দেহ পড়ে আছে। বিষয়টি দেখে কৌতুহল নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম সেই তরুণ ছেলেটি রক্তাক্ত অবস্থায় আছে। আমি আরিচামুখী সার্ভিস লেনে দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে থাকি। আমি ভিডিও ধারণ করার কয়েক সেকেন্ড পরেই সেই তরুণকে সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে একজন পুলিশ সদস্য টেনে হেঁচড়ে ফেলে দেয়। সে সময় আমি খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কারণ আমার পাশে দুই একজন সংবাদকর্মী ছাড়া আর সবাই পুলিশ। এরপরেও আমি কোন কিছু চিন্তা না করে পুেরা ভিডিওটি ধারণ করতে থাকি। এর কিছু সময় পরেই ইয়ামিনের নিথর দেহ মহাসড়কের উপরে ফেলে রেখে পুলিশ পিছু হেঁটে চলে যাচ্ছিলো। তখনও আমি ভিডিও চালিয়ে যাচ্ছিলাম, এর কিছু সময় পর পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে করে আমার চোখ জ্বালাপোড়া শুরু হয়। নিঃশ^াস নিতে কষ্ট হয়। আমি তখন চোখের যন্ত্রণা নিবারণের জন্য এক টুকরো কাগজ আর আগুনের খোঁজ করতে থাকি। এরই মধ্যে হঠাৎ করে একটা ইটের টুকরা এসে আমার পায়ে লাগে। এতে করে আমি মারাত্মক জখম হই। সেই দিনের হৃদয়বিদারক এই দৃশ্য মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
পরে জানতে পারি শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন ছিলেন এমআইএসটির (মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) চতুর্থ বর্ষের কম্পিউটার সায়েন্সের মেধাবী শিক্ষার্থী। তার বাসা সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়। জন্ম ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর। সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছিলেন। বুয়েট ও রংপুর মেডিকেলে সুযোগ পেলেও ভর্তি হননি। ছাত্র রাজনীতির সমালোচক ছিলেন। ছাত্র জীবনের প্রতিটি ধাপে মেধার সাক্ষর রেখেছেন ইয়ামিন। নিজে পড়াশোনা করতেন, জানতেন, বিতর্ক করতেন- ছিলেন এমআইএসটির বিতর্ক ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
শহীদ ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন একজন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ইয়ামিন ছিল আমাদের আদরের। সেদিন জোহরের নামাজ পড়ে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গিয়ে ছেলের নিথর দেহ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
ইয়ামিনের বাবা আরও বলেন, ইয়ামিনকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় প্রথমে দাফন করার চেষ্টা করি। সব প্রস্তুতি নেওয়ার পর সেখানকার থানা থেকে জানানো হয়, ময়নাতদন্ত ছাড়া কোনো লাশ সেখানে দাফন করতে দেওয়া হবে না। তারপর সাভারের তালবাগের কবরস্থানে দাফন করার চেষ্টা করলে সেখানেও একই অজুহাতে বাধা দেওয়া হয়। অবশেষে ব্যাংক টাউন কবরস্থানের সভাপতির আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমার সন্তানকে সেখানেই চিরনিন্দ্রায় শায়িত করার সুযোগ পাই।
কাফনের কাপড় ছাড়াই দাফন করি, কারণ আমি মনে করি, সে শহীদ হয়েছে। ইসলামেও শহীদদের রক্তমাখা কাপড়ই কাফন হিসেবে ধরা হয়। মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। যেন আর কোনো বাবা-মা এমন কষ্ট না পায়। কোনো স্বপ্ন আর যেন বুলেটের আঘাতে ভেঙে না পড়ে। ইয়ামিন হত্যা মামলাটি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মামলার তদন্তে ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। গত ১২ জুলাই গুলী ছোঁড়ার অপরাধে কনস্টেবল মাহফুজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি প্রাথমিকভাবে গুলী করার কথা স্বীকার করেছেন। আগামী ১২ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।
ইয়ামিন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না জানিয়ে সন্তানহারা এই পিতা আরও বলেন, আমার সন্তান মারা যাওয়ার পর সে কোন রাজনৈতিক দল করেÑ এসবের খোঁজ নেওয়া হয়। অথচ আমরা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে ছিলাম না, এখনো নেই। আমার স্ত্রী নাসরিন সুলতানা গৃহিণী। একমাত্র মেয়ে শাইখ আসহাবুল জান্নাত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমাদের গোটা পরিবারই রাজনীতির বাইরে। বরং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হয়েও কোটার বিরুদ্ধে ছিল ইয়ামিন। সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করার পর ইয়ামিন বুয়েটে পড়ার সুযোগও পেয়েছিল। তবে গ্রামের বাড়িতে আমাদের প্রতিবেশী আবরার ফাহাদকে বুয়েটে ছাত্রলীগ পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভে-দুঃখে সেখানে ভর্তি না হয়ে ইয়ামিন এমআইএসটিতে ভর্তি হয়। কারণ, সেখানে কোনো রাজনীতি নেই। স্বপ্ন ছিল ওখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবে। সেই সব স্বপ্ন আজ বিষাদে পরিণত হয়েছে। বাকি জীবন আমাদের এই কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।
সাভারের প্রথম শহীদ হিসেবে ইয়ামিনের আত্মত্যাগের পথ ধরে ইতোমধ্যে পুলিশের গুলীতে ঝরে গেছে অর্ধশতাধিক প্রাণ। যাদের নির্দেশে এবং নেতৃত্বে ছাত্র-জনতাকে পাখির মতো গুলী করে হত্যা করা হয়েছে, তারাও বহাল রয়েছেন স্বপদে। এসব হত্যাকা-ের বিচার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন সবাই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন বাবু বলেছেন, আমরা ইয়ামিনসহ সব হত্যাকা-ের বিচার চাই। এদের বিচার না হলে জাতি আমাদের ক্ষমা করবে না কখনোই।