জুলাই আন্দোলনে রাস্তার দেওয়াল থেকে মানুষের মনের

দেওয়ালে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে এই গ্রাফিতি: তানভীর আহমেদ

জুলাই আগস্টের আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছিল গ্রাফিতি। মিছিল মিটিংয়ের পাশাপাশি রাস্তার পাশের দেওয়াল থেকে মানুষের মনের দেওয়ালে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে এই গ্রাফিতি। জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি তা নিয়ে দৈনিক সংগ্রামের সাথে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় চারুকলা বিভাগের ১৫-১৬ বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ। ঢাবি চারুকলা বিভাগের ভবনের নিচে বসে তার সঙ্গে কথা বলেছেন ইবরাহীম খলিল।

তখন আমাদের হল বন্ধ আমরা আন্দোলন করছি ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে। এখানে আমাদের দ্ইুটা গ্রুপ মুভ করলো। একটা হলো আমরা যারা সিনিয়র স্টুডেন্ট বন্ধুবান্ধব আশপাশে থাকতাম। প্রথমে আমরা মোহাম্মদপুর থানার আশপাশে ছিলাম পরবর্তীতে যখন এপিসি বের হয়ে গেলো টিয়ার সেল মারলো তখন ধানমন্ডি আই হাসপাতালের সামনে চলে আসি। আমাদের শুরুটা দেওয়ালে দেওয়ালে। দেওয়ালে স্প্রে মেরে। তখন আসলে গ্রাফিতি করার মতো লম্বা সময় নেই। দেওয়ালে লেখন দিয়ে শুরু হয় যাকে লোকার ভাষায় বলা হয় চিকা মারা। আমরা লিখছি এসব কি হচ্ছে ? এক দফা এক দাবি। আমার সাথে ইউডার কিছু স্টুডেন্ট ছিল। আমাদের চারুকলার কিছু আর্স্টিস্ট ছিল। এর বাইরে বন্ধু ও সিনিয়র ছিল। এর বাইরে স্থানীয় কিছু ইয়ুথ, যারা এইট নাইনে বা নাইন টেনে পড়ে। একদম তরুণ ১৬-১৭ বছর, দেখলেই বোঝা যায় নতুন গোফ গজাচ্ছে। এরা যেন কোথা থেকে আমাদের সাথে আসছে। তখন স্প্রে করার জন্য নিজের কাছে আর কয়টা থাকে। যার কাছে যা ছিল, সবাই সব নিয়ে নামলো। একজন এলো তিনি রিকশাওয়ালা ছিল। তিনি বললেন আপনাদের রংতো শেষ হয়ে যাচ্ছে আপনারা আলকাতরা দিয়ে লিখেন। দেওয়ালে লিখলে সহজে উঠবে না। প্রশাসন আমাদের লিখনগুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তখন আমরা আলকাতরা দিয়ে লেখা শুরু করলাম। হাসিনার পদত্যাগ চাই। একদফা এক দাবি ইত্যাদি। এমনো সময় দেখা গেছে আমরা লিখছি আর অনেক দূর থেকে এপিসি দেখা যাচ্ছে। তিনচারটা বাচ্চা সব সময় পাহারা দিচ্ছিল যে কোন দিক থেকে এপিসি আসে। কাছাকাছি এলেই আমার মুভ করে ভেতরের গলিতে চলে যাচ্ছিলাম। আবার যখনই এপিসি চলে গেলো আমরা মেইন রোডে এসে লেখা শুরু করতাম। আর কখনো টিয়ার সেল খাচ্ছি ধোঁয়া চোখ জ¦লছে এরকম সিচ্যুয়েশনও গেছে।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা আসলে লেখার জন্য কোন সময়টাকে বেছে নিতেন ?

তানভীর আহমেদ : আমাদের সময় ছিল ভর দুপুরের দিকে। প্রশাসন সকাল থেকে রাত্র পর্যন্ত মোভ করতো। আমরা যেই জায়গাটায় ছিলাম পুলিশ এবং র‌্যাব নিয়মিত পাহারা দিতো। মাঝে মধ্যে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার সেল এবং সাউন্ড গ্র্যানেড মেরে যেতো। সকাল ১১ টার দিকে প্লান নিয়ে বের হতাম। এটলিস্ট তিনটা চারটা পর্যন্ত যতটুকু সুযোগ পেতাম কাজ করতাম। আসছে প্রশাসন দৌড়ে ঢুকছি ভিতরে। স্থানীয় যত বাসা এবং বাসার মালিকেরা, আমার খুব ভাল করে মনে আছে, দেখলে বোঝা যেত যে তারা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটার লোক না। তারা খাবার রুটি পানি নিয়ে এসে দিয়ে যেতো। তারা বলতো আমরা তোমাদের পাশে আছি। সিভিল জোনে জনগণ যখন সমর্থন দিচ্ছিল। আমরা সবচেয়ে বেশি কাজটা করতাম ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত।

দৈনিক সংগ্রাম : গ্রাফিতি করতে গিয়ে কি কেউ গ্রেফতার হয়েছিল ?

তানভীর আহমেদ : আমরা গ্রেফতার হইনি। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের সামনে একটা দল প্রটেস্ট করছিল, তারা সড়কে আল্পনা করছিল। তখন দেখলাম পুলিশ একদম থাবা দিয়ে তিন চারজনকে গাড়িতে তুলে ফেলছিল। এবং তাদের গ্রেফতার করে ফেলছিল। তখন অকেক আর্টিস্ট ছিল ৮০ থেকে ১০০ জন। সিভিলিয়ানরা মিলে তখন পুলিশকে ঘিরে ধরে। তখন আর তাদের নিয়ে যেতে পারেনি। জুলাইয়ের শেষ দিকে আমাদের কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। তখন আর্টিস্টরা রাস্তায় নেমে এসেছে। তখন আমার মনে আছে রাসেল নামের একজন আর্টিস্ট তিনি পিঠে পাখা লাগিয়ে গায়ে লালরং লাগিয়ে প্রতিবাদের কাজ করছিলেন। সাথে নারী আর্টিস্টরাও ছিল।

দৈনিক সংগ্রাম : ওই সময়টায় কেউ কি আপনাদের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিল ?

তানভীর আহমেদ : কোন কোম্পানি নয় বরং সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে সহায়তা পাওয়া গেছে। যেমন একজন রিকশাওয়ালা তার গ্যারেজ থেকে আলকাতরা নিয়ে চলে আসে। আর বাচ্চারা যারা ছিল তার অধিকাংশই ইংলিশ মিডিয়ামের। তারা রং নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে সহায়তা করেছে। যারা সেভেন এইটের বাচ্চারা নিয়ে এসেছে হোয়াইট পেটসেল কালার। মোম কালার। সে মোম দিয়ে দেওয়ালে যা পারছে আঁকছে। আমরা তো প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। দ্রুত মোভ করতে পারছি। কিন্তু বাচ্চারাতো তা পারছে না। তাই বাচ্চাদের মাঝখানে রাখার চেষ্টা করেছি। কারণ পুলিশ মাঝে মাঝে ফায়ার করছিল। আমাদের সামনে একবার বাচ্চাদের ওপর ফায়ার করলো মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। দুইটা ছেলে পরে গেলো। একজনের হাতে গুলি লেগেছে, আরেকজনের সাইড থেকে ¯িপন্ট হয়ে বের হয়ে গেছে।

দৈনিক সংগ্রাম : এই যে বাচ্চার কাজ করছিল তাদের অবিভাবকরা কি সহায়তা করছিল ?

তানভীর আহমেদ : অবিভাবকরা সহায়তা করছিল। তাদের দেখলেই বোঝা যেতো যে তার ধনবার মানুষ। তারা কখনো গাড়ি ছাড়া বাইরে বের হয়না। তারা তাদের কাজের মহিলা নিয়ে এক হাতে রুটির বাক্স আরেক হাতে পানির বোতল নিয়ে চলে আসতো। আর বলতো নাও বাবারার খাও। তারা প্রত্যেকে বাসা থেকে বের হয়ে আই হসপিতালের পাশে একটা গলি আছে, ওই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতো টুথপেস্ট নিয়ে। বলতো চোখে টুথ পেস্ট দিয়ে রাখলে টিয়ারসেলের ধোঁয়ায় যেন কোনরকম সমস্যা হবে না। রাস্তায় চলা মানুষ যারা প্রাইভেটকার দিয়ে চলছে তারাও আমাদের সাপোর্ট দিয়েছে, যে যেখান থেকে পেরেছে। দেখা গেছে কি আগুনের সংকট, টিয়ার সেল আসতেছে, তখন বাঁশ কাঠ লাঠি যে যা পেরেছে এনে দিয়েছে। আমি দেখেছি ইচ এন্ড ইভরি ওয়ান আমাদের সমর্থন দিয়েছে। কোন দলকে একা ক্রেডিট দেবো না। আমার বাসার পাশেই একজন প্রতিমন্ত্রীর বাসা ছিল। ওনার বাসা বা বিল্ডীং থেকে লোকজন বের হয়ে আমাদের সাপোর্ট দিয়েছে। এ থেকে মনে হয়েছে যে নাহ, সরকারের পতন হবেই।

দৈনিক সংগ্রাম : এতোক্ষণতো ঢাকা ভার্সিটির বাইরের কথা বললেন। ঢাবিতে কিভাবে গ্রাফিতিগুলো হলো ?

তানভীর আহমেদ : সবচেয়ে কাছে থেকে আমি বলি। আমার হল জিয়া হল। আন্দোলনের সূচনাটা আমার চোখ দিয়ে দেখেছি। আন্দোলনটা যখন শুরু হয় তখন ৭১ হলের সামনে গিয়ে ছেলেরা, ছাত্রলীগ যখন গেইটটা নক করে তখন হচ্ছে আন্দোলনের সূচনা। আমি তখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছি। ছাত্রদেও ওপর এ্যাটা শুরু হলো। আমার হলের দক্ষিনে বঙ্গবনধু হল। দেখলাম ৭১ হলের ভেতরে যারা ছিল সবাই আটকে পড়েছে। আমি দেখলাম ছাত্রলীগ যখন অ্যাটাক করছে তখন প্লান মাফিক অ্যাটাক করছে। সবাই মিলে একসাথে দৌড়ে অ্যাটাক করছে। আবার একবারে পেছনে চলে আসছে। আর সিভিল ছাত্র যখন অ্যাটাক করছে তখন একটা পক্ষ অ্যাটাক করছে আরেক পক্ষ ভয় পেয়ে পিছু হটছে। একারণে সাধারণ ছাত্ররা বেশি আহত হয়েছে। ছাত্রলীগ স্ট্র্যাটিজিক্যালি ফোর্সের মতো আক্রমণ করেছে। তারা একে অপররের সাথে যোগাযোগ রাখছে। দাওয়া দিচ্ছে এক সাথে ব্যাক করা লাগলে একসাথে ব্যাক করেছে। সিভিলিয়ান যারা তারা একগ্রুপ অ্যাটাক করছে আরেক গ্রুপ পিছিয়ে যাচ্ছে মাঝখানে যারা তারা মাঝখানে অ্যাটাক খাচ্ছে খাচ্ছে মাথা ফেটে যাচ্ছে। তিনটার দিকে আন্দোলনটা যখন শিফট হয়ে রাজু ভাস্কর্য্যরে দিকে চলে আসছে তখন, আমি এবং আমার বন্ধু জালাল উদ্দিন শিহাব এবং নাসিম তিনজন হাঁটতে হাঁটতে দেখতে আসলাম যে কি হচ্ছে। দেখলাম প্রশাসন ক্যাম্পাস ভরা। আমরা যখন ভিসি স্যারের বাস ক্রস করে রোকেয়া হলের দিকে যাচ্ছি,তখন দেখলাম মহানগর ছাত্রলীগসহ বাইরের ইউনিটগুলো ঢুকছে। তারা তখন বাচ্চাদের ওপর অ্যাটাক করলো। এগুলো ভাইরাল হলো। দেখা যাচ্ছে দুইটা মেয়েকে পিটুনি দিচ্ছে একটা ছেলে। একটা মেয়ের নাক ফেটে গেছে। তখন অলরেডি নেটওয়াক ডাউন। ওয়াই ফাইগুলো রান করছে। তখন আসলে যারা জোর করে ছাত্রলীগে ছিল তারা বললো আমরা কি করলাম। আমার ক্যাম্পাসের বাইরের লোক মেয়েদের নির্যাতন করবে ? এই তো হলে হলে আন্দোলন শুরু হলো পর দিনতো ছাত্রলীগ ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া হলো। সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠলো আমার ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন, আমার ক্যাম্পাসে টোকাই কেন ?

আমাদের বিশ^বিদ্যালয় স্বায়ত্বশাসিত। আমাদের হল বন্ধ করার ক্ষমতা অন্য কারো নেই সিন্ডিকেট ছাড়া। তখন সিন্ডিকেট টিচাররা আন্দোলনে তাদের পে- স্কেল নিয়ে। পরে অবশ্য তারা আপোস করেছে। কিন্তু আন্দোলনে আমি যা দেখেছি, সবাই ছিল। এখন হয়তো রাজনীতির কারণে বলবে অমুক মাস্টার মাইন্ড। আমি বলবো সবাই মাস্টার মাইন্ড। যখন ছাত্রলীগ হল ছাড়া হলো তখন দেখলাম কাটাবন মসজিদের পাশে যারা লোকাল ছাত্রলীগ-যুবলীগ তারা ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করছে। আন্দোলনের সময় আমি মেয়েদের সেভ করছিলাম। তখন আমাকে নিয়ে নিউজ হয় যে আমি মেয়েদের সেভ করছি।

আন্দোলনের প্রথম দিকে অবশ্য কনফিউজ ছিলাম একারনে যে শেখ হাসিনা কোন না কোনভাবে আন্দোলন থামিয়ে দিচ্ছে। একবার আমাকে ক্যাম্পাস থেকে গুম করা হেেয়ছে।

দৈনিক সংগ্রাম : ঢাবি ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি কেমনে শুরু হলো ?

তানভীর আহমেদ : ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি শুরু হয় যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল। এর আগে করার সুযোগ ছিল না। কারণ এখানে প্রশাসনের অতিরিক্ত নজরদারি ছিল। হাসিনা পালানোর পর তো ফ্রি স্টেট। আগেতো পুলিশ পুরো ক্যাম্পাস কর্ডন করে রাখছিল।

দৈনিক সংগ্রাম : আসলে জুলাই গ্রাফিতির শুরু কখন থেকে ?

তানভীর আহমেদ : জুলাই গ্রাফিতির শুরু অনলাইনে। অনেকের গ্রাফিতি ভাইরাল হয়েছে। এসব গ্রাফিতি আন্দোলনে সহায়তা করেছে। যখন ছাত্রদের ওপর অ্যাটাক হয়। তখন থেকেই অনলাইনে কার্টুনগুলো ভাইরাল হওয়া শুরু করে। যার অবস্থান থেকে শত শত হাজার হাজার কার্টুন অনলাইনে আসার শুরু করে। ইন্টারনেট অফ করার আগ পর্যন্ত তারা ফাইট করেছে। যখন লাশের ভিডিও সামনে এলো তখন কার্টুন তৈরি করে যে যার মতো পোস্ট করেছে।

এরপর আর কোনজনের কাছে সীমাবদ্ধ থাকলো না। বা বোর্ন। যে যার জায়গা থেকে কাটুর্ন তৈরি করলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার শুরু করলো। যখন নয় দফা ঘোষণা করা হয় তখন আমরা বুঝতে পারছিলাম যে কর্মসূচি এক দফায় যাবে। কারণ শেখ হাসিনার মতো দানব যে হত্যাকান্ডের জন্য ক্ষমা চাইবে না। এবং তার পতন হবেই হবে।