কাঁচাপাট রপ্তানীর বন্ধে পাট রপ্তানীকারকরা সংকটে রয়েছেন। অনেক কাঁচাপাট ব্যবসায়ী ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। গত দুই মাসে অনেক ব্যবসায়ী এক বেলও কাঁচাপাট রপ্তানী করতে পারিনি। এরা শ্রমিকদেরকে বসিয়ে বসিয়ে মজুরী দিতে হচ্ছে। রপ্তানী বন্ধ থাকায় হাজার হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে ব্যবাসায়িদের ক্ষতির পাশাপাশি পাট শিল্পে ও পাটপণ্য রপ্তানির কাজে জড়িত প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ হারাতে পারেন। আগামী ১০দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধান না হলে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশন (বিজেএর) নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান খন্দকার আলমগীর কবির। গতকাল রোববার নতুন দায়িত্ব নিয়ে এ ঘোষণা দেন তিনি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পাট শিল্পের সূচনাই ঘটে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এর আশেপাশেই গড়ে ওঠে। আদমজী জ্টু মিলকে ঘিরে তৈরী হয় বিপুল পরিমানের কর্মসংস্থান। ঢাকা,খুলনা ও চট্টগ্রাম এই তিনটি প্রধান এলাকায় ছড়িয়ে আছে এর প্রতিষ্ঠাগুলো। পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ।

সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে পাটচাষির সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে। জিডিপিতে পাটের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। কৃষি জিডিপিতে পাটের অংশ প্রায় ১ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ আসে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি থেকে।

তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। একসময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মোট বৈদেশিক আয়ে পাটের অংশ ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ দশমিক ৮৮ শতাংশে।

সূত্র মতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৮ সেপ্টেম্বর এক পরিপত্র জারি করে বলেছিল, এখন থেকে কাঁচা পাট রপ্তানি করতে হবে সরকারের অনুমতি নিয়ে। এ পরিপত্র জারির পর রপ্তানির সব ধাপ শেষ করা কাঁচা পাটকেও আটকে দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কাঁচা পাট রপ্তানিকারকেরা তখন হঠাৎ বিপাকে পড়েন।

ব্যবসায়ীরা বলেন, একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি ও তাৎক্ষণিক প্রভাবগুলো কী হবে, তা বিবেচনায় না নিয়েই ৮ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপনটি জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর এ কারণে বন্দরের জরিমানা ও বাড়তি ট্রাকভাড়া দিতে হয়েছে তাঁদের। প্রায় ৫০ হাজার টনের কাছাকাছি কাঁচা পাটের চালান তখন আটকে ছিল।

সূত্র জানায় , বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) এবং বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) যৌথভাবে গত ২৫ আগস্ট বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের কাছে একটি আবেদন করে। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা পাট রপ্তানিতে সরকারের অনুমতির বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছিল।

বিজেএমএও বিজেএসএর আবেদনে বলা হয়েছিল, বর্তমানে পাটের ভরা মৌসুমে প্রতি মণ পাটের দাম ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা। অথচ আগের বছরগুলোতে প্রতি মণ পাটের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২০০ টাকা। পাটশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল কাঁচা পাট। এই কাঁচা পাটের অভাবে কারখানাগুলো প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে পারে না। মাঝখানে সুযোগ নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।

বিজেএসএ সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে পাটপণ্য উৎপাদনের জন্য লাগে ৬০ লাখ বেল। পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান,নেপাল, চীনসহ ১৩টি দেশে ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি করা হয়েছে। ওই অর্থবছরে কাঁচা পাট রপ্তানি হয় ১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বা ১৬ কোটি ৪ লাখ ৮৭ হাজার মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে ৯ কোটি ডলারের বেশি আয় আসে ভারত থেকে।

পাট শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিটু বলেন, কাঁচা পাট রপ্তানি কার্যক্রমের সাথে দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান সম্পৃক্ত। কোন কারণে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করা হলে এই খাত সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়ে অস্থিরতা বিরাজ করবে। সরকারি পাটকল গুলো নিয়ম-নীতি মেনে যেভাবে বেতন,বোনাস ও গ্রাসুইটি দিতেন। কিন্তু বেসরকারি পাটকল মালিকেরা শ্রমিকদের কোনো সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে দৈনিক ১৬০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা হাজিরা দিয়ে থাকেন। কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ হলে এ ধরনের বৈষম্য আরো বেড়ে যাবে। কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করা হলে পাটের দর ব্যাপক কমে যাবে। যার ফলে এক দিকে যেমন এদেশের কৃষক পাটের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে পাট চাষে আগ্রহ হারাবে,অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন ব্যাহত হবে। কৃষকদের ও কাঁচা পাট রপ্তানীকারকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে শুধু এক পক্ষকে সুবিধা প্রদান করার জন্য কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করা কোনোক্রমেই যুক্তিসংগত হতে পারে না।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মো. ফরহাদ আহম্মেদ আকন্দ জানান,পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে এই মৌসুমে পাটের উৎপাদন ৮৩.১৫ লক্ষ বেল। দেশের অভ্যন্তরীণ কাঁচা পাটের সর্বমোট চাহিদা প্রায় ৫৫ লক্ষ বেল। দেশে প্রকৃতপক্ষে পাটের কোন সংকট নেই। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরও উল্লেখযোগ্য পরিমান কাঁচা পাট উদ্বৃত্ত থাকে এবং এই উদ্বৃত্ত পাটের মধ্য হতে বর্তমানে মাত্র ৮-১০ লক্ষ বেল কাঁচা পাট আমরা বিদেশে রপ্তানি করে থাকি, যার পরিমাণ মোট উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশ। প্রতি বছর পাট মৌসুমের শুরুতেই বিশেষ একটি মহল কম মূল্যে পাট ক্রয়ের উদ্দেশ্যে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। যার কারনে বিগত দিনগুলোতে আমরা সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশন (বিজেএর) নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান খন্দকার আলমগীর কবির বলেন, বর্তমানে কাঁচাপাট রপ্তানী বন্ধ থাকায় কাঁচাপাট ব্যবসায়ী রপ্তানীকারকরা সঙ্কটে রয়েছেন। অনেক কাঁচাপাট ব্যবসায়ী ঋনে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। ২ মাসে আমরা এক বেলও কাঁচাপাট রপ্তানী করতে পারি নাই। শ্রমিকদেরকে বসিয়ে বসিয়ে মজুরী দিতে হচ্ছে। রপ্তানী বন্ধ থাকায় হাজার হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা শীঘ্রই উপদেষ্টা মহোদয় ও মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলবো। আগামী ১০ দিনের মধ্যে রপ্তানী বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো।