মাসুদ রানা। আহবায়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ২৪’র জুলাই আন্দোলনে সামনে থেকে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দৈনিক সংগ্রামকে সেই উত্তাল সময়ের গল্প শুনিয়েছেন। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।

দৈনিক সংগ্রাম : কিভাবে আপনি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হলেন?

মাসুদ রানা : ৫ই জুন থেকে মূলত আমি আন্দোলনের সাথে যুক্ত। জুলাই আসার পর যখন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কমিটি ঘোষণা করলো তখন ১লা জুলাই থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু করি। এবং আন্দোলন ধীরে ধীরে গতি পেতে শুরু করে। ১৫ জুলাইয়ের আগে আমরা রেগুলার কর্মসূচি পালন করতে থাকি। ১৫ জুলাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই দুপুর দুইটার দিকে রাজু ভাষ্কর্যের দিকে। আমরা যাওয়ার সাথে সাথে সব মিছিল এক হয়ে শাহবাগের দিকে রওয়ানা হই। শাহবাগের দিকে যেতে যেতে আমরা ভিসি চত্বরের দিকে ঢুকি। হলগুলোর মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় বিকাল তিনটার দিকে ছাত্রলীগ বিভিন্ন হল থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর এলোপাতারি হামলা করে। আমরা তখন ওখানে প্রতিরোধ করতে থাকি। হঠাৎ একটা হল থেকে সম্ভবত জসিম উদ্দিন হল থেকে আমাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং ফাঁকা গুলী ছুড়তে থাকে। আমরা তখন প্রতিরোধ করতে থাকি। সেদিন আমাদের বোনদেরও রক্তাক্ত করা হয়। আমরা সামনের কাতারে ছিলাম এবং মাইকগুলো ছিল। প্রথমেই আমাদের চারটা মাইক ভেঙে দেয়। আমাদের সামনে মেয়েদের ওপর এমন হামলা করে যে তারা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। ওরা মেয়েদের ওপর ইট পাটকেল মেরেছে। পরে আমরা আবার ভিসি চত্বরে এলাম। এরপর একটা অংশ শহীদমিনার মুখী হলাম আরেকটা অংশ ঢাবির নীলক্ষেতের দিকে গেল। এই অংশের ওপর ছাত্রলীগের লোকজন ওপর হামলা করে। একটা লাল বাসের আড়ালে তারা অবস্থান করে ওদের এলোপাতারি হামলা ও মারধর করে। সেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। তাদের ন্যাশনাল মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। সেদিন বিকালে আমি বাসায় চলে আসি। পরে ন্যাশনাল মেডিকেলে সহকর্মীদের দেখতে যাবো সে সময় তৎকালীন শিবিরের সেক্রেটারি আসাদুল ইসলাম ভাই বর্তমানে সভাপতি ফোন করে বলেন যে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। শহিদুল্লাহ হলের সামনে রাত ১২টার দিকে অবস্থান নেই। এবং ওই দিন ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হল ছাড়া করে দেই। ছাত্রলীগকে হল ছাড়া করে সেদিন আমাদের আন্দোলনের সমাপ্তি। তারপর সারা দেশের ন্যায় আমরাও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করি। ওই মিছিল যখন রাইসাহেব বাজার অতিক্রম করে, সিএমএম কোর্টের সামনে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছোটন আমাদের ওপর হামলা করে। গুলি করে। তার গুলিতে আমাদের ফেরদৌস, অনিক, নাসিম মেহেদি হাসান প্রভাসহ চার পাঁচজন গুরুতর আহত হয় এবং গুলিবিদ্ধ হয়। তাতে তাদের বাঁচা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। আল্লাহর রহমতে তারা বেঁচে আছে। ১৬ জুলাই আবার আমাদের ওপর হামলা করে তখন আমরা রাত ৮টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান করি। ১৭ জুলাই কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করি। তখন পুলিশ আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় গেইট অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া পার্কের ওখান থেকে আমাদের ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নেয়। তাতে তৎকালীন প্রশাসন আমাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ওই দিনের মতো আন্দোলন শেষ করে।

১৮ তারিখ আমরা আন্দোলন করার প্রস্তুতি থাকলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের সামনে দেখি পুলিশ আর পুলিশ। গেইট অবরোদ্ধ চারদিকে পুলিশ আর পুলিশ। আমি বাসায় অবস্থান করি। আমার সহযোদ্ধারা বলে এখানে এলে গ্রেফতার করা হবে। আমাদের সহযোদ্ধারা বাংলাবাজার মিছিল করার চেষ্টা করে। ওখান থেকে ৪/৫জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষকরা তাদের ছাড়িয়ে আনে।

১৮ তারিখ কর্মসূচি পালন করতে না পেরে আমরা ১৯ জুলাই ওয়াইফাই ইন্টারনেট যখন সব বন্ধ হয়ে যায়, আমরা সকালে আমাদের প্রধান সমন্বয়ক নুরনবী, ছাত্রদলের মনির ভাইসহ আমরা তিনজন গেটের সামনে আসি। পুলিশকে বলি আমরা এখানে মিছিল করবো আপনারা সরেন। পুলিশ পুরো এলাকা খালি করে দেয়। সুত্রাপুর কতোয়ালি থেকে গাড়ি নিয়ে আসে। তখন পুলিশের সাথে তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে প্রশাসন এসে বলে তোমরা চলে যাও। আমরা তখন চলে যাচ্ছিলাম। ওই অবস্থায় ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছ থেকে দুপুর ১২টার দিকে নুর নবীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু আমাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আমরাও টার্গেটে ছিলাম। কিন্তু আমাকে আর গ্রেফতার করতে পারলো না। নূর নবীকে গ্রেফতারের পর বড়ভাইদের সাথে একত্রিত হই। ওখানেও পুলিশ টিয়ারসেল রাবার বুলেট মারতে থাকে। তখন পুরো লক্ষ্মীবাজার কলতা বাজারসহ পুরো এলাকা কর্ডন করে ফেলে। পরে দেখি পুরো লক্ষ্মীবাজার মানুষ আর মানুসে সয়লাব হয়ে গেছে। প্রতিরোধ করার জন্য সবাই প্রস্তুতি নিয়েছে। তখন আমি জুমাআর নামাজ রাস্তায় পড়লাম। সবাইকে ঘোষণা করলাম যে আপনারা নামেন। পুলিশ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ এদের সবার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। তখন মানুষ দলে দলে আসতে থাকে। ঐদিন বিকাল চারটার পর পুলিশ আগে থেকেই সমানে রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড মারছে। বিকাল চারটার পর তা আরও তীব্র আকার ধারণ করে। বিকাল চারটার পর তারা গুলী করা শুরু করে। ওই সময় আমাদের ৭ জন শহীদ হয়। এরমধ্যে কবি নজরুলের চার জন। বাকী তিনজন স্থানীয়। সেদিন দুুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সংঘর্ষ করি। রাত আটটার পর আমরা চলে যাই। ১৯ তারিখের পর আর জগন্নাথে তেমন একটা কর্মসূচি পালিত হয়নি। আমরা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে ঘোষণা দিতাম যে আমরা সবাই শহীদ মিনারে অবস্থান করবো। আমরা আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে শহীদ মিনারে অবস্থান করতাম। ৪ তারিখ অর্থা] ৪ আগস্ট আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোগ্রাম ঘোষণা করি। মিছিলের আয়োজন করা হয়। সেই মিছিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ সবাই একাকার হয়ে আমাদের ওপর হামলা করতে থাকে। তাতে আমাদের সহকর্মীরা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই দিন কোর্ট-কাচারিতেও অনেক মানুষকে শুট করা হয়। ৫ আগস্ট আমরা সবাই শাহবাগের দিকে যাই। তারপর শুনি শেখ হাসিনা চলে গেছে।

দৈনিক সংগ্রাম : এখানে আসলে প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিল?

মাসুদ রানা : প্রশাসনের বলতে গেলে নির্বাক অবস্থানে ছিল। তাদের আসলেই কিছু করার ছিল না। প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। তারা সেই কাজটি করেনি। তারাতো আসলে আওয়ামী লীগের পক্ষের মানুষ ছিল, তাই তারা এমনটা করেছে।

দৈনিক সংগ্রাম : আন্দোলনের সময়ের একটা স্মরণীয় ঘটনা বলেন যা ভুলে যাওয়ার নয়।

মাসুদ রানা : ১৯ জুলাই আমাদের নূর নবীকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় লক্ষ্মীবাজার এলাকাতে পুলিশ গুলী চালালো। এই দৃশ্য ভুলার না। এটা আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ দিবস ঘোষণার প্রস্তাব পর্যায়ে।