‘হাসিনা পালায় না’? সেই সাবেক স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। আর তার দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছিলেন- ‘পালিয়ে যাব না, পালাবো কোথায়?’ সেই ওবায়দুল কাদেরও পালিয়ে গেছেন রাতের অন্ধকারে। শুধু হাসিনা ও আর কাদের নয়, পতিত সরকারের কয়েকডজন নেতা দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। পলাতক হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ১২ জন পলাতক নেতার বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছে। রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিনটি ধাপে আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। গতকাল শনিবার পুলিশ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় মুখে দৃঢ় ঘোষণা ছিল ‘পালাবো না।’ কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতেই সেই কথার কোনো মূল্য রাখেননি ওবায়দুল কাদের। নিজে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গেলেও, ফ্যাসিস্ট হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলের অনেক নেতাকর্মীকে ফেলে রেখে গেছেন চরম বিপদের মুখে। এখন তিনি অবস্থান করছেন বিদেশের আরামদায়ক পরিবেশে, আর পেছনে পড়ে আছে তার দলের ছিন্নভিন্ন অবস্থা, এবং বিচারের মুখোমুখি হওয়া হাজারো কর্মী।
হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আবেদন: জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জন পলাতক নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে ‘ রেড নোটিশ’ জারির আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। দেশের বাইরে অবস্থানরত এসব ব্যক্তিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের নিকট পৃথক তিন দফায় এ আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের বিরুদ্ধে এই রেড নোটিশ চাওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন-আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, আদালত, রাষ্ট্রপক্ষ অথবা তদন্ত সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে ইন্টারপোলের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) এই আবেদন করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ আবেদনে আর্থিক অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনাসহ বাকিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণাদি সংযুক্ত করে আবেদন করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ও বেনজীর আহমেদ ছাড়া অন্য ১০ জনের বিষয়ে গত ১০ এপ্রিল এনসিবি আবেদন জমা দেয় ইন্টারপোলের কাছে। এর আগে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশের জন্য প্রয়োজনীয় নথি ও সুপারিশ পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে। শেখ হাসিনার বিষয়ে ইন্টারপোলকে রেড অ্যালার্ট জারির অনুরোধ করা হয় ২০২৪ সালের নবেম্বর মাসে। অন্যদিকে, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইন্টারপোলে আবেদন করা হয়। এর আগে ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য নির্দেশনা দেন। ইন্টারপোলের মাধ্যমে অভিযুক্তদের দেশে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ভারতসহ যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, সেই চুক্তির আওতায় ফেরত আনার উদ্যোগও নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে এই প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘসূত্রতা সাপেক্ষ এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকায় তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানিয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকা-, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার মামলা। এ মামলায় তার সঙ্গে আসামি করা হয়েছে তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও। এছাড়া ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগে একটি এবং গত সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় আরেকটি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ও অন্যান্য প্রসিকিউটরদের ভাষ্যমতে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আজ রোববারএই মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে।
যেভাবে কাজ করে: ইন্টারপোল সারা বিশ্বের পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। পুলিশবাহিনীর মতো মনে হলেও এটি কোনো পুলিশি সংস্থা নয়। এর প্রধান কাজ অপরাধীদের ধরতে পুলিশকে সহায়তা করা। অপরাধের পর এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে পালিয়ে গেলে তাকে ধরতে ডাক পড়ে ইন্টারপোলের। এই প্ল্যাটফর্মে দুর্ধর্ষ মাফিয়া, খুনি, যুদ্ধাপরাধী কিংবা ফেরারি আসামিদের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করে বিশ্বের সব দেশের পুলিশ। অপরাধের তদন্ত থেকে শুরু করে ফরেন্সিক ডেটা বিশ্লেষণ পলাতকদের খুঁজে বের করা, প্রতিটি ক্ষেত্রে সহায়তা করে সংস্থাটি। যুদ্ধাপরাধ, মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি, দুর্নীতি এমন ১৭ ধরনের অপরাধ তদন্তে সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা করে ইন্টারপোল। আসামি ফেরাতে যেভাবে আবেদন করা হয় সন্দেহভাজন ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে আবেদন করতে হয় রেড নোটিশ জারির। রেড নোটিশ ছাড়াও ৭ ধরনের হয়ে থাকে ইন্টারপোলের সমন। রেড নোটিশকে এই সংস্থাটির আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ব্যবস্থায় মুহূর্তের মধ্যে ১৯০ সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশের কাছে চলে যায় অপরাধীদের অপরাধ, সর্বশেষ অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য। ইন্টারপোলের কাছে প্রত্যর্পণ, আত্মসমর্পণ বা অনুরূপ আইনি পদক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে এবং সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার করার জন্য ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। তবে এই সংস্থা ‘রাজনৈতিক, সেনা সম্পর্কিত, ধর্মীয় ও জাতিগত’ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে না।
বাংলাদেশে ইন্টারপোল ১৯৭৬ সালে ইন্টারপোলের সদস্যপদ গ্রহণ করে বাংলাদেশ। অপরাধ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের নাম ইন্টারপোলে পাঠানো ও তদারকির দায়িত্ব ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো’র (এনসিবি)। ইন্টারপোলের হালনাগাদ তালিকায় দেখা যায়- ১৯৫টি সদস্য দেশের মোট ৬ হাজার ৫৮৩ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা আছে। এর মধ্যে ৬২ জন বাংলাদেশি। তালিকায় থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে আছেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত দুবাইয়ে পলাতক রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান, শীর্ষ সন্ত্রাসী ফেরদৌস জাহাঙ্গীর ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ, শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি প্রমুখ। তালিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামিদের নাম ও ছবি রয়েছে। সবশেষ আরাভ খানকে ফিরিয়ে আনতে তোড়জোর শুরু হয়। কিন্তু এখনও ফেরানো যায়নি তাকে। তবে বাংলাদেশেই নজির আছে রেড নোটিশ জারির পর ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৫ জনকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর গতকাল শনিবার রাতে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করতে ইন্টারপোল সহযোগিতা করে থাকে। অন্যদিকে বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে সেটিও সংশ্লিষ্ট দেশ ইন্টারপোলকে জানায়। যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে, সেগুলো এখন ইন্টারপোলে প্রক্রিয়াধীন। তিনি বলেন, বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামীদের ফিরিয়ে আনতে এটাই পদ্ধতি। এর আগেও পলাতক কয়েকজন সন্ত্রাসীকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।