বাংলাদেশের সীমান্তকে বিভিন্নভাবে অস্থির করে রেখেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ’র আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা বেড়েছে। কিছু দিন পরপরই সীমান্তে বিনা উস্কানিতে বিএসএফ বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলী করে হত্যা করছে। এ সময়ে সীমান্ত হত্যার ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধের জন্য বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না ভারত। তারা কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। পাশাপাশি বিএসএফ নতুন করে শুরু করেছে পুশ ইন। ভারত থেকে সেদেশের নাগরীকসহ বাংলা ভাষাভাষী প্রায় দুই হাজার মানুষকে জোরপূর্বক পুশ ইন করেছে।

জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাসের শাসনামলে অন্তত ৩৪ জন বাংলাদেশীকে গুলী ও নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী আগের বছরগুলোতেও সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৩১ ও ৩০ জন ছিল। বারবার আশ্বাসের পরও এই হত্যাকা- থামেনি। এদিকে ভারত চলতি বছর ৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। যার মধ্যে রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিকও রয়েছে। সীমান্তে বিস্ফোরণ, ড্রোন উড়ানো ও গুলী ছোঁড়ার ঘটনাও ঘটছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাঝে বিএসএফ প্রায় প্রতি মাসেই বাংলাদেশিদের হত্যা করেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিএসএফ-এর হাতে ১৫ জন নিহত ও ২৯ জন আহত হয়েছেন।

আসকের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলীতে নিহত হয়েছেন ১৩ বাংলাদেশী নাগরিক। আহত হয়েছেন আরও ১১ জন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন মাসে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ১০ জন, আহত ১৪ জন। অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে ১ জন বাংলাদেশী এবং বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১ জন নিহত হন।

জানা যায়, ৫ আগস্টের পর অনুপ্রবেশের ঘটনা কমে গেলেও বিএসএফ-এর কর্মকা-ে সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত বিজিবি কোনো ভারতীয় নাগরিকককে দেখামাত্র গুলী ছোড়েনি। তারপরও বিনা উসকানিতে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশিদের টার্গেট করে হত্যা ও অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, দু’টি দেশের সীমান্তে এভাবে দেখামাত্র গুলি করে হত্যার মতো ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে ঘটেনি। বিএসএফ যেভাবে গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা করছে এর বিপরীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যদি এমন ঘটনা ঘটাতো তা হলে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। বিজিবির সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা সীমান্তে কোনো ভারতীয়কে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েনি। অবৈধভাবে কয়েকজন বিএসএফ সদস্য বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়লেও তাদেরকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হয়। বাংলাদেশ সহনশীল আচারণ করলেও সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে হত্যাকা- থামছেই না বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার চিত্র যেন এক অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক বৈঠক, আলোচনা, প্রতিশ্রুতি কিছুতেই কাজে আসছে না। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে এলেও তাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই। বরং সীমান্তে ৯৫ শতাংশ মৃত্যুই হচ্ছে বিএসএফ-এর গুলীতে। সীমান্ত হত্যার এমন চিত্র শুধু দুই দেশের সম্পর্ককেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও নৈতিকতার ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত শুধু সম্মতই হয়, সহিংসতা থামেনি। বিএসএফ বন্ধ করেনি মারণাস্ত্রের ব্যবহার। তারা বলছেন, সীমান্তে চোরাচালান রোধ যেমন জরুরি, তেমনই মানবাধিকারও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনো সভ্যদেশের কাম্য হতে পারে না। সীমান্তে হত্যা শূন্যে আনতে হলে ভারতকে আন্তর্জাতিক চাপে রাখতে হবে। বিএসএফ-এর গুলী, নির্যাতনের ঘটনা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়াচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সঙ্গে চীন, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সীমান্ত থাকলেও গত ১০ বছরে এসব সীমান্তে কোনো বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকা-ের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে।

সীমান্ত এলাকার মানুষ বলছে, নানা সন্দেহ থেকে নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালায় বিএসএফ। সীমান্ত এলাকার মানুষ নানা প্রয়োজনে জিরো-লাইনের আশপাশে যান। অথচ বিএসএফ ওপার থেকে বিনা উসকানিতেই চোরাচালানি কিংবা মাদক ব্যবসায়ী মনে করে গুলি চালায়। এমন ঘটনাও আছে, গোয়াল ঘর থেকে গরু ছুটে সীমান্তের দিকে চলে গেছে। সেই গরু আনতে গিয়েও বিএসএফ-এর গুলি-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। চোরাচালান, গরু পাচার, ফেনসিডিল বা মাদকদ্রব্য পাচার, ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে আনা এবং বাংলাদেশের কিছু পণ্য ভারতে নেওয়া-এমন কার্যক্রমের সন্দেহে অনেক বাংলাদেশিকে গুলি করে বিএসএফ। সীমান্ত অতিক্রম করলে বা সন্দেহভাজন মনে হলে আটক করতে পারে; কিন্তু এভাবে গুলি চালানো মেনে নেওয়া যায় না। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সীমান্তে অনুপ্রবেশও এর অন্যতম একটি কারণ। অনেক সময় সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশীরা ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। কখনো কখনো কৃষিকাজ বা মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে তারা ওপারে যায় কাজের সন্ধানে। এই অনুপ্রবেশ রোধ করতে গিয়ে বিএসএফ গুলি চালায়। যদিও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এমন পরিস্থিতিতে গুলী না করে গ্রেফতার করার কথা। এছাড়া সন্দেহজনক চলাফেরাও অন্যতম কারণ। কখনো সীমান্তে হাঁটাহাঁটি বা জমি চাষের সময় সাধারণ মানুষকে চোরাচালানকারী বা অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে গুলি করা হয়। এতে নিরীহ সাধারণ মানুষও প্রাণ হারায়। সীমান্ত এলাকার মানুষ রাতের অন্ধকারে চলাচল করেন। এ সময় সন্দেহে গুলি চালায় বিএসএফ। সীমান্ত এলাকা জটিল ও জনবহুল হওয়ার কারণে কখনো কখনো ভুল বোঝাবুঝি থেকেও গুলী চালানো হয়। সাধারণ চাষিকে বা পথচারীকেও ‘অনুপ্রবেশকারী’ মনে করে গুলী চালানোর ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ফেনীর পরশুরামের বাশপদুয়া সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত এবং একজন আহত হন। এরমধ্যে নিহত মো. ইয়াছিন লিটনের (৩২) লাশ একদিন পর শুক্রবার রাতে বাংলাদেশে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় মিল্লাত হোসেন নামে আরও একজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া শেরপুর সীমান্ত দিয়ে ২১ জন রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠিয়েছে বাহিনীটির সদস্যরা।

নতুন হুমকি পুশ ইন: এদিকে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভারত নানা অজুহাতে পুশ ইন শুরু করে। শুধু বাংলাদেশিকেই পুশইন করা হচ্ছে না ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদেরকেও পুশইন করা হচ্ছে। জোরপূর্বক তাদেরকে সেদেশে আটকের পর পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। পাঠানো হচ্ছে রোহিঙ্গা নাগরিকদেরকেও। আন্তর্জাতিক রীতির তোয়াক্কা না করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অবৈধ পুশ ইন করেই যাচ্ছে ভারত। বিজিবির পক্ষ থেকে বরা হয়েছে, বাংলাদেশের ৪ হাজার ৪২৭ কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা বিজিবির পক্ষে প্রতিনিয়ত পাহারা দিয়ে পুশ ঠেকানো যাচ্ছে না। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল ভূমিও আছে। সে তুলনায় জনবলের সংকট রয়েছে বিজিবির। প্রায় ৫৭ হাজার জনবল দিয়ে দীর্ঘ সীমানা পাহারা দিয়ে যাচ্ছে বিজিবি।

সর্বশেষ বড়লেখার কুমারশাইল ও নিউ পাল্লাথল সীমান্ত দিয়ে শুক্রবার ও শনিবার দুদফায় ১৬ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে বিএসএফ। শনিবার ভোরে ১১ জনকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যাচাই বাছাই কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। এর আগে আটক ৫ জনকে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এরআগে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে ১১ শিশুসহ ২১ জন রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠিয়েছে বিএসএফ। বৃহস্পতিবার রাতে ঘটনাটি ঘটে বলে ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন ৩৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদি হাসান জানান। ওই ২১ জনকে আটক করে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। বিজিবি সূত্র জানায়, আটক ব্যক্তিরা ২০১৭ সালে কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যান। এক মাস আগে দেশটির পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে।

ভারতের পুশ ইন নিয়ে গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, ভারত থেকে গত এক মাসে ১৫০০ বাংলাদেশিকে পুশইন করানো হচ্ছে এই তথ্যটা সঠিক। তবে পুশইনের সংখ্যাটা কমে আসছে। দুপুর পৌনে ১২টায় সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীতে র‌্যাব-১১ এর কার্যালয় পরিদর্শনকালে তিনি এ কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভারতে যেসব বাংলাদেশি রয়েছে তাদের তো নিতে হবে। সেটা ১০ কিংবা ২০ বছর পর হোক। তবে আমাদের নাগরিকদের সঙ্গে যেসব রোহিঙ্গাদের পাঠানো হয়েছে তাদের গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমরা ভারতকে বলেছি আমাদের কোনো নাগরিক যদি ওইখানে থেকে থাকে তাহলে একটা নিয়মের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে। যেমনটা আমরা ভারতীয়দের নিয়মের মধ্যে পাঠিয়ে থাকি। কিন্তু তারা নিয়মের মাধ্যমে না পাঠিয়ে নদীর পাড়ে, জঙ্গলে ফেলে যায় এটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য না। এ বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। প্রতিবাদে কিছুটা কাজও হচ্ছে এবং পুশইনের সংখ্যাটা কমে আসছে।