গ্রামীণ খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়নে উশর এর ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, উৎপাদিত ফসলের উপর উশর প্রদান করা যে এটি ফরজ ইবাদত সেটি অনেকেই জানে না। এটিকে সমাজের সর্বস্তরে প্রচার ও প্রসার ঘটাতে মসজিদভিত্তিক উদ্যোগ নেয়ার উপর গুরুত্বদেন তারা। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ইসলামিক ইকোনমিক রিচার্স ব্যুরোর (আইইআরবি) উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানের পল্টন কার্যালয়ে এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
আইইআরবির চেয়ারম্যান ও দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশক ও সাবেক সম্পাদক আবুল আসাদের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়াল্ড ফিস সাইনটিস্ট ডি এম ইউসুফ আলী। আইইআরবির এজিএস এম সফিউল্লাহর সঞ্চালানায় এতে প্যানেল আলোচক ছিলেন কান্ট্রি ডাইরেক্টর এট কাতার চ্যারিটি ড. আমিন হাফিজ ওমার, উশর ডেভেলপমেন্ট ফাইন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মোশতাক আহমেদ, আইইআরবির জিএস ড. মিজানুর রহমান। এছাড়া আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, মো: মহিউদ্দিন, ড. মো: ফলসাল খান, মো: কামরুজ্জমান, ড. ণেছারুল হক প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে আবুল আসাদ বলেন, উশর প্রদান করা একটি ফরজ কাজ। কিন্তু এর কালেকশান বা ডিস্ট্রিবিউশান কিভাবে হবে, সেটি নিয়ে কোনো আইডিয়া নেই। তবে এই কাজটি যতদিন বর্তমান সরকারের ন্যায় সরকার দেশে প্রতিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন সেভাবে প্রচার প্রসার হবে না। অনেকেই বলেছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করার জন্য। কিন্তু তারাও পারবে না। কারণ কারা তো যাকাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। দেশের যাকাত সিস্টেমটাকেই ঢেলে সাজাতে পারছে না। তাই উশরকে সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারের পরবির্তন ছাড়া উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, উশরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মসজিদভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। মসজিদগুলোর মাধ্যমে উশর যে একটি ফরজ ইবাদত, সেটি তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, উশর প্রদানের ক্ষেত্রে অনেকেই খরচের কথা বলেছেন। আমার কথা হলো, আল্লাহ তো খরচের কথা বলেই দিয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতের বিষয় জানেন বলেই তো সব কিছু খোলাসা করে দিয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতে উশরের উপর আরও ভালো কিছু করার ঘোষণা দেন।
আইইআরবির জেনারেল সেক্রেটারি ড. মিজানুর রহমান বলেন, জমির উৎপাদিত ফসলের উশর দিতেই হবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামের এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইমাম আবু হানিফার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, উশর সবাইকেই দিতে হবে। এক্ষেত্রে চাষের খরচ বাদ দিয়ে বাকি পণ্যের উশর দেয়া বাধ্যতামূলক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৮ কোটি ৬০ লক্ষ মেট্টিক টর ফসল উৎপাদিত হয়। এর ১০ শতাংশ অথবা ৫ শতাংশ যদি উশর হিসেবে গরীব মানুষের মাঝে বন্টর করা যায়, তাহলে দারিদ্রের হারও কমে যাবে।
পবিত্র কুরআনের সূরা আনআমের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি সৃষ্টি করেছেন সুশোভিত ও অসুশোভিত উদ্যানসমূহ এবং (সৃষ্টি করেছেন) খেজুরগাছ ও বিচিত্র স্বাদের শস্য, জলপাই ও আঙুর, যা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ ও অসাদৃশ্যও। এসবে ফলধারণ করলে তোমরা তার ফল খাও এবং কাটার দিনে তার প্রাপ্য অংশ দান করো। তবে অপচয় করো না, নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। (সূরা আনআম: ১৪১)
এছাড়া আল্লাহর নবী বলেছেন, নদী ও মেঘ দ্বারা যা সিক্ত করা হয়, তার এক দশমাংশ (যাকাত হিসেবে) পাওনা রয়েছে। আর যা জলচক্র দ্বারা সিক্ত করা হয়, তার অর্ধ-দশমাংশ (যাকাত হিসেবে) পাওনা রয়েছে। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে তিনি (নবি) বলেছেন, যাকাতের মাধ্যমে তোমাদের সম্পদ পবিত্র করো।
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বলেন, আমাদের সমাজের লোকজন যাকাতের বিষয়টাকেই বেশি জানেন। গরীবরাও জানেন, যাকাত তাদের অধিকার। কিন্তু উৎপাদিত ফসলের উপর যে আল্লাহ ১০ শতাংশ বিলি বন্টনের বিধান রেখেছেন, সেটি অনেকেই জানেন না। এ জন্য আলেম ওলামাদের উশর সম্পর্কে আরও বেশি করে বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। এটি যে একটি ফরজ বিধান, বিষয়টি সেভাবে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, উশর প্রদানের মাধ্যমে সমাজের দারিদ্রের হারও করে যাবে।
তিনি বলেন, কোনো ভূমি যদি একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় পানি দ্বারা চাষ করা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ফসলের জাকাত ‘উশর’ ও ‘নিসফ উশর’ এর মাঝামাঝি হিসেবে ৭.৫% (সাড়ে সাত শতাংশ) দিতে হবে অথবা ১০% ও ৫% এর মধ্যবর্তী যেকোনো পরিমাণ আদায় করলে হবে। সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘বৃষ্টির পানি, প্রবাহিত ঝরনার (নদীর) পানি ও মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা দ্বারা যে ফল-ফসল উৎপাদিত হয়, তার দশ ভাগের একভাগ (১০%) এবং সেচের মাধ্যমে যে ফল-ফসল উৎপাদন করা হয়, তার বিশ ভাগের এক ভাগ (৫%) জাকাত প্রদান করতে হবে।’
কোরআন মজিদের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি (আল্লাহ) এমন যে যিনি সৃজন করেছেন বাগান সুউচ্চ (মাচানে লতানো) ও অনুচ্চ (মাচানবিহীন) এবং খেজুর বৃক্ষ ও খেত, তার স্বাদ বিভিন্ন, আর জলপাই ও ডালিম, যেগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য আছে, বৈসাদৃশ্যও আছে। তোমরা খাও তার ফল যখন ফল পরিপক্ব হয়; আর তার হক (উশর) প্রদান কোরো তা উত্তোলনের দিনে আর (উশর প্রদান না করে) সীমা লঙ্ঘন কোরো না, নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’
সকল প্রকার ফল ফসলের ‘উশর’ প্রদান করতে হবে, তা যে পরিমাণই হোক এবং যেই প্রকারেরই হোক। যেসব উৎপাদনের উশর প্রদান করতে হয় (১) ফলফলাদি যেমন খেজুর, আঙুর, আম, জাম, কাঁঠাল, তরমুজ ইত্যাদি (২) শাকসবজি যেমন লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, বেগুন, আলু, কচু ইত্যাদি (৩) মসলা যেমন পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, সয়াবিন ইত্যাদি (৪) খাদ্যশস্য যেমন ধান, গম, যব, ভুট্টা, ইত্যাদি এবং (৫) ফসল যেমন শণ, পাট, তুলা, রেশম, আখ, লবণ ইত্যাদি।
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগে সব মুসলিম নাগরিকের জমিই উশরি ছিল। খলিফা হজরত উমর (রা.) শুধুমাত্র যুদ্ধ-বিজিত ভূমিতে ‘খারাজ’ বা কর আরোপ করেন। এতে মুসলিম ফকিহরা একমত হয়েছেন, মুসলিম মালিকানাধীন কোনো ভূমিতে খারাজ বা ভূমিকর আরোপ করা যাবে না শুধু বিজিত দেশের অমুসলিম নাগরিকদের ভূমিতে খারাজ আরোপ করা হবে। ইমাম আবু ইউসুফ (র.) বলেছেন, যে সকল ভূমির মালিকগণ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, সে সকল ভূমি উশরি। (আল মাবসূত)। মুসলিম বিজয়ের সময় মালিকহীন, পরিত্যক্ত বা পতিত ভূমি যা পরবর্তীকালে মুসলিমরা মালিকানা লাভ করেন বা ব্যবহার করেন; সে সব ভূমিও উশরি হিসেবে গণ্য। মুসলিম শাসক কর্তৃক মুসলিম নাগরিককে চাষাবাদের জন্য প্রদত্ত ভূমি এবং মুসলিম কর্তৃক আবাদকৃত সব ভূমিতে উশর প্রযোজ্য। সে মতে বাংলাদেশের সব ফসলি ভূমি উশরি। তাই এই সব ভূমির উৎপাদনের উশর প্রদান করা জরুরি। ‘উশর’ সে সকল খাতে ব্যয় করা যায়, জাকাত যে সকল খাতে ব্যয় করা যায়। ইসলামি ফকিহগণ কৃষিজ সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত করেছেন।
ড. নেছারুল হক বলেন, অনেকেই মনে করেন, শুধু ধান আর গমের উশর দিতে হয়। কিন্তু ইসলামিক স্কলারসহ অধিকাংশ মাজহাব বলেছেন, মধু, শাক সবজি, বিশেষ করে উৎপাদিত সব কিছুরই উশর দিতে হবে। এটি যাকাতের ন্যায় একটি ফরজ ইবাদত। এটিকে নিছক দান বলে মনে করা যাবে না।
গবেষক মো: কামরুজ্জমান বলেন, উশর যেমনীভাবে একটি শরিয়ী বিষয়, তেমনী এটি একটি অর্থনৈতিক বিষয়ও। প্রকৃত দ্বীনি শিক্ষার অভাবে এই বিষয়টি হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই শুধু যাকাতের বিষয়টিকেই প্রাধ্যান্য দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, ইসলামি চিন্তাবিদদের উশর সম্পর্কে আরও ব্যাপকহারে প্রচার করতে হবে। জনগণকে বুঝাতে হবে, এটি ফরজ ইবাদত। উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ গরীবদের মাঝে বিলিয়ে যদতে হবে।
ড. মো ফয়সাল খান বলেন, যারা চাষাবাদ করেন, তাদের অনেকেই জানেন না, উশর একটি ফরজ ইবাদত। অনেকেই না বুঝে দান করে থাকেন।
মো: মহিউদ্দিন বলেন, উৎপাদন যেভাবেই হোক না কেন, ফসলের উশর দিতে হবেই। এটি দারিদ্র্যের অধিকার। এটা তাদের প্রাপ্য। এউ উশর প্রদানের মাধ্যমে চুরিও কমে যায়।
মূল প্রবন্ধে ডি এম ইউসুফ আলী বলেন, সম্পদের উপর যাকাত যেভাবে ফরজ, সেভাবে উৎপাদিত ফসলের উপর উশর প্রদান করাও ফরজ। এই উশর প্রদানের ক্ষেত্রে উদাসীনতা অনেক বেশি। এটা নিয়ে সরকারও কাজ করে না। তারা ইসলামিক ফাইন্ডেশনের মাধ্যমে যাকাতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু সেটিও সঠিকভাবে আদায় হয় বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলন, উশর সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক ইমামই জানেন না উশর এ বিষয়ে। উনারা শুধু যাকাতের বয়ান করে থাকেন। তাই উশর সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে ইমামদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, উশর যাকাতের মতোই একটি ফরজ বিধান। এটি জমির উৎপাদিত ফল ও ফসলের উপর ধার্য করা হয়। বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয়ে উৎপন্ন ফসলের যাকাত সাধারণত এক দশমাংশ বা ১০% হয়, যা উশর নামে পরিচিত। আর সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন ফসলের যাকাত হয় এক বিশমাংশ বা ৫%, যা নিসফ উশর নামে পরিচিত। জমিতে উৎপাদিত শস্যের যাকাতকে উশর বলা হয়। উশর মানে হলো দশমাংশ, অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ। যদি সেচ দিয়ে ফসল ফলানো হয়, তাহলে বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হয়।
তিনি বলেন, বৃষ্টির পানিতে উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে যদি কেউ বৃষ্টির পানিতে বা প্রাকৃতিক ঝরণার মাধ্যমে সেচ দিয়ে ফসল ফলায়, তবে তার উৎপাদিত ফসলের ১০% যাকাত দিতে হবে। সেচ দিয়ে উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে যদি কেউ পাম্প বা অন্য কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে সেচ দিয়ে ফসল ফলায়, তবে তার উৎপাদিত ফসলের ৫% যাকাত দিতে হবে। এভাবে উশর হলো ফসলের যাকাত যা প্রত্যেক মুসলমান কৃষকের জন্য একটি ফরজ ইবাদত।