আমরাতো হাত দিয়ে এবং এক্সরে করে দেখেছি। বিষয়টা এমননা যে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলী করা হয়েছে। আহত হওয়ার যে প্যাটার্ন। চোখে মুখে গুলী করে দেওয়া হয়েছে চোখ এবং মুখ ড্যামেজ করে দেওয়ার জন্য। মেরে ফেলার জন্য গুলী করা হয়েছে --- ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা
ডাক্তার যাকিয়া সুলতানা নীলা। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক। তিনি কাছে থেকে দেখেছেন জুলাই আন্দোলনে আহতদের আর্তনাদ। সে গল্প বলেছেন দৈনিক সংগ্রামকে। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা কত তারিখ থেকে জুলাই আন্দোলনে আহত রোগী পাওয়া শুরু করলেন ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : ১৭ জুলাই থেকে আমরা রোগী পেতে শুরু করি। ১৭ জুলাই দৃশ্যটা এমন ছিল যে থেকে ৬ জন আহত রোগী আমাদের হাসপাতালে আসে। তারপর ১৮ জুলাই থেকে শুরু হয় রোগী আসা। সেদিনের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিভৎস। আমি তখন অপারেশন থিয়েটারে রেগুলার ওটি করছিলাম। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। তখন বর্তমান হাসপাতালের এডি রেজুয়ানুর রহমান সোহেল ভাই, ওটিতে গিয়ে নক করে বলেন নীলা তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসো। নিচেতো নরকের দরজা খুলে গেছে। আমি ওটি শেষ করে নিচে নেমে আসি। নিচের দৃশ্য দেখে আমি ধপাস করে পড়ে যাই। আমি দেখতে পাই, শত শত মানুষ। কেউ একহাতে চোখ ধরে আছে। কেউ দুই হাত দিয়ে দুই চোখ ধরে আছে। চোখগুলো ক্ষত বিক্ষত। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। বিভৎস চেহারা দেখতে পাই। এদের বয়স হচ্ছে ১৪ থেকে ২৫/২৬। ইয়াং জেনারেশন যাদের বলে। তারাপর আমাদের দশ টেবিলে ওটি শুরু হয়ে গেলো। সেদিন ওটি রাত ১০টা পর্যন্ত চলেছে। আমরা হাসপাতালের জনশক্তি যারা ছিলাম সবাই ওটিতে অংশ নিয়েছি। আমি বাসায় এসে দেখি ওয়াই-ফাই কানেকশন অফ হয়ে গেল। তারপর ১৯ তারিখ। সেদিনের চেহারাও একইরকম। ১৯ তারিখ সকালেই হাসপাতালে গেলাম। রাস্তায় যানবাহন ছিল না। বাসা থেকে রিকশায় ভ্যানে করে গেলাম। সেদিন আলাপ করে সকাল থেকেই ওটি শুরু করি। কারণ আমরা বুঝলাম সকাল থেকে ওটি শুরু না করলে শেষ হবে না। এরপরও শেষ করা যায়নি। কারণ সেদিন আরও বেশি রোগী আসে। সেদিন কারো বিশ্রাম ছিল না। ২০ তারিখতো কারফিউ শুরু হয়ে গেলো। ২৩ জুলাই পর্যন্ত প্রচুর রোগী ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আঘাতের বিষয় নিয়ে যদি বলেন।
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : রাবার বুলেটের কথা মিডিয়াতে এলো। সেখানে রাবার বুলেট বলে কিছুই ছিল না। পুরো বিষয়টা হচ্ছে মেটালিক বুলেট এবং রিয়েল বুলেট। মেটালিক বুলেট হচ্ছে মেটালের তৈরি। ছোট ছোট ক্ষুদ্র। এর গতিবেগ হচ্ছে প্রতি সেকেনেড ৭০০ মিটার। মিডিয়াতে বলা হচ্ছিল রাবার বুলেট। প্রকৃতপক্ষে সেখানে রাবারের কোন অস্তিত্বই নাই। আমরাতো হাত দিয়ে এবং এক্সরে করে দেখেছি। বিষয়টা এমননা যে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য করা হয়েছে। আহত হওয়ার যে প্যাটার্ন। চোখে মুখে গুলী করে দেওয়া হয়েছে চোখ এবং মুখটাকে ড্যামেজ করে দেওয়ার জন্য। মেরে ফেলার জন্য গুলী করা হয়েছে। এমন আহত ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় আমাদের কাছে আসছিল। পরবর্তীতের আমাদের রোগী আবার বাড়তে থাকে তিন তারিখ থেকে। ৩,৪,৫,৬ এবং ৭ আগস্ট এই কয়দিন অনেক রোগী আসে। এর মধ্যে তিন আগস্ট আমি হাসপাতালে ডিউটি করেছি। ডিউটি শেষে শহীদ মিনারে গিয়েছি। নাহিদদের ডাকে আমি শহীদ মিনারে যাই। সেদিন ছিল শনিবার।
দৈনিক সংগ্রাম : পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরও শহীদ মিনারে গেলেন ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : হ্যাঁ হ্যাঁ। তিনটার পর পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে আমি শহীদ মিনারে গিয়েছি।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনারতো তখন সরকারি দায়িত্ব পালন করছিলেন। চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কি কোন বাধা দেওয়া হয়েছিল ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : আমাদের হাসপাতালে স্বাধীন চিকিৎসক পরিষদ নামে আওয়ামী লীগের পেশাজীবী ছিল। বলতে গেলে সব হাসপাতালেই ছিল। তারা নানাভাবে আমাদের ডিমোরালাইজ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ চিকিৎসক, আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারাতো মনে করলাম এরা আমাদেরই সন্তান। এরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এদের আমরা যেকোন মূল্যে চিকিৎসা দিয়েছি। আমাদেরকে ডিমোরালাইজ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। যারা মনে করেছে যে আমরা বোনাফাইট খাঁটি আওয়ামী লীগ তারা নিজেরা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত ছিল। সেখানে কেবল আওয়ামী লীগ না সাধারণ ডাক্তারও আছে। যারা দেশকে ভালবাসে। যারা মানুষকে ভালবাসে তারা মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছে। তারা এই পরিস্থিতিতে দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসেনি।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনাদেও কাছে আসা রোগীদের চোখের কোন অংশের ক্ষতি নিয়ে বেশি এসেছে ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : বিষয়টা খুলে বলি। দেখবেন চোখের কোনায় একটু বালি লাগলে কেমন লাগে। সেখানে মেটালিক বুলেট। চোখটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানে চোখটা ফেটে গেছে। আরেকটা বিষয় চোখের কালো অংশমনিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। অথবা চোখের সাদা অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। অথবা এমন হয়েছে যে অতিদ্রুত আঘাত পাওয়ার কারণে নার্ভও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটাকে ট্রমাটিক অপটিক নিউরোপ্যাথি বলে। এতো জোরে এসেছে যে চোখের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। স্কেচ মোরেচ হয়েছে। রেটিনা ছিঁড়ে পুরো আলাদা হয়ে গেছে। চোখের ভেতরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কোন কোন সময় দেখা গেছে এতো দ্রুত গতির পিলেট এটা যে, চোখের ভেতর ঢুকে পেছনের হাড্ডিতে গিয়ে আটকে গেছে, এরকম ঘটনা ঘটেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : এক্ষেত্রে আপনাদের চিকিৎসা কি ছিল ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : আমরা সিস্টেম অনুযায়ী চিকিৎসা করেছি। রোগী আসার সাথে সাথে প্রাইমারি রিপেয়ার করেছি। প্রাথমিক রিপেয়ার। অর্থাৎ গুলী লেগে যে ছিদ্রটা তৈরি করলো সেটা বন্ধ করতে হবে। কারণ যতক্ষণ সেটা ওপেন থাকবে ততক্ষণতো ভেতরের কনটেইন বের হয়ে আসবে। ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটাকে আমরা বলি প্রাথমিক মেরামত। সাথে সাথে রোগী গুলোকে স্ক্যান করে ফেলেছিলাম। এক্সরে করে দেখেছিলাম যে ভেতরে ছিঁড়ে গেছে নাকি অন্য কিছু। এক্স-রে করলে দেখা যায়। আর রোগীরা একটু স্ট্যাবল হলেই রেটিনা অপারেশনের জন্য এনেছি। আমার ওপরে যারা চিকিৎসক আছেন। তারা মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন। কার জন্য কি করতে হবে।
দৈনিক সংগ্রাম : প্রতিদিন কি বোর্ড বসতো ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : আমি ৪ আগস্টের একটা ঘটনা বলি, সেদিন ৪টা পর্যন্ত রোগী দেখেছি। নবাব নামের একটা রোগী আসে আমার কাছে। সেগুলী খেয়েছে এসেছে নেত্রকোনার মদন থেকে। সেদিন রাস্তাঘাটে মানুষ কমে যাচ্ছে। আসলে ৫ তারিখে কি হবে এই আশঙ্কায়। সেটা ছিল রোববার। আমার ডিউটি শেষ। নবাবকে বসিয়ে চোখের ছবি নিয়ে স্ক্যান করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কি যাওয়ার কোন জায়গা আছে ? সে বলে আমি আশুলিয়াতে চলে যাবো। জায়গা না থাকলে আমার বাসাতে চলো। আমরা যখন দেখতাম তখন সিনিয়রদের পরামর্শ নিতাম। একজনের নাম না নিলেই না। সহযোগী অধ্যাপক মেজবাহুল আলম। আমরা সব সময় মেজবাহ স্যারের পরামর্শ নিয়েছি। কোন জটিলতা দেখা দিলেই আমরা মেজবাহ স্যারের স্মরণাপন্ন হতাম। কর্নিয়ার বিষয় থাকলে সেখানে রেফার করতাম। আমাদের চোখের আলো নাই এমন একটা ডিপার্টমেন্ট আছে। সেখানেও রোগী পাঠাতাম।
দৈনিক সংগ্রাম : দেশেতো একটাই বিশেষায়িত হাসপাতাল। সেখানে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে কেমন রোগী আসতো ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : ঢাকার বাইরে থেকে একেবারে কম আসতো না। অনেক। আমি কিছু এলাকার নাম বলতে পারি। গাজীপুর। গাজীপুরের মধ্যে কয়েকটা জায়গা। তারপর ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, ময়মনসিংহ এসব জায়গা থেকে আমরা অনেক রোগী পেয়েছি। ঢাকা থেকেও এসেছে। কিছু পয়েন্ট, যেমন: মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা চাঁনখারপুল এলাকার। হাসপাতালের প্রায় ৭শ’ রোগী। এদের প্রায় সবাই আমাকে চিনে। মোটামুটি সবার সাথেই আমার কমবেশি কথা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করেছি। কে কোথায় থেকে এসেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : পুলিশী ঝামেলা হতো কি-না ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা: চোখের অপরাশেন করে রোগীরা চলে যাচ্ছিল। চোখের সমস্যার অপারেশন পূর্ণাঙ্গ অজ্ঞান করে হয় না। শুধু মাত্র ইনজেকশন দিয়ে অপরাশেন করা হয়। তখন তাদের জ্ঞান থাকে। তারা বুঝতে পারছিল। আমরাও বলে দিতাম যে পর দিনে এসে ড্রেসিং করে যাবেন। আবার আমাদের কিছু রোগী ড্রেসিং করতে আসার সময় গ্রেফতারও হয়েছে। এরকম আমরা জানা মতে একজন আলীম আরেকজন আছে আশরাফুল। কাকতালীয়ভাবে দুইটা ছেলেই এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনি বললেন যে ৩ আগস্ট অফিস ডিউটি করার পরও শহীদ মিনারে গেলেন। সেটা কোন স্পৃহা থেকে ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা : আমি হাসপাতাল থেকে যখন বাসায় এলাম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ডাক দিয়েছে তারা কিছু বলবে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কিছু দাবি জানাবে। আমিতো এসময় ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমার স্বামীর স্পৃহাটা বেশি ছিল। উনি ১৮ জুলাই থেকেই রাস্তায় ছিল। আমি আমার হাজবেন্ডকে বলছি যে আমি যেতে চাই। তিনি বলেন আমিতো শহীদ মিনারের কাছাকাছি দাড়াবো। তুমি একটু দূরেই দাঁড়িয়ো। আর একটু পরেই যাইয়ো। গুলী যদি চালায় একটা মানুষতো বেঁচে থাকতে হবে। আমি তার কথাটা রেখেছিলাম।
দৈনিক সংগ্রাম : তার মানে জীবনের ঝুঁকি জেনেও গিয়েছেন সেখানে ?
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা: উনি (স্বামী) সেখানে তিনটা থেকেই ছিল। এবং শহীদ মিনারের কাছে। আমাকে বলে তুমি একটু দূরে দাঁড়িয়ো। গোলাগুলীতে একজন মরে গেলে আমাদের সন্তান নূছাইবার একজন বাবা অথবা মা থাকবে।